অসমাপ্ত অপেক্ষা- ১
শহরের এক কোণে ছোট্ট একটা পাড়া। যে পাড়ার নাম নেই, ঠিকানা নেই… আছে শুধু কিছু চেনা- অচেনা মুখ আর ভাঙা ভাঙা জীবনের গল্প। সন্ধ্যা নামলেই যেই পাড়াটা হয়ে উঠে জীবন্ত। এক টং দোকানের সামনে জটলা জমে যায়। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে, সিগারেটের পাকানো ধোঁয়া মিশে যায় বাতাসে। কারো ঠোঁটে রবীন্দ্রসংগীত, কারো গলায় পুরনো প্রেমিকার কথা। কারো মুখে রাজনীতি, কারো ব্যর্থ জীবনের হিসাব-নিকাশ।
ভিডিও
শহরের অন্যপ্রান্ত থেকে আমি আসি এখানে। কেউ জানে না কেন। জানলেও বিশ্বাস করবে না। বন্ধুরা বলবে —
“তুই তো . . . ! তোরতো এসব ভালোবাসা-টালবাসার বয়স পার হয়ে গেছে রে। প্রেম কি এখনো ধরে বসে আছিস?”
কিন্তু তারা জানে না, ভালোবাসা বয়স দেখে আসে না। ভালোবাসা কখনো হিসাব-নিকাশের অঙ্ক মেনে চলে না। সে আসে হঠাৎ করে। কোনো কারণ ছাড়াই। কাউকে না জানিয়ে। কারো অনুমতি না নিয়েই।
আমি আসি শুধু এক কারণে। সেই মানুষটার জন্য। সে আসবে। আমি জানি। হ্যাঁ, আসবেই। কখনো সন্ধ্যার পর। কখনো রাত গভীর হলে। আবার হয়তো একেবারে মাঝরাতে। তারও কোনো ঠিক নেই।
আমি চায়ের কাপ হাতে বসে থাকি। ঘনঘন সিগারেট ধরাই। লোকজনের গল্পের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাই। শুধু যদি একবার আসে একটিবার- এই ভাবনায়। যদি চোখের কোণে ধরা দেয়। আমি শুধু বলবো —
“আপা, কেমন আছেন?”
এইটুকু বলার জন্য আমি আসি। এইটুকু শোনার আশায় আমি সারারাত বসে থাকি।
গত রাতটা ছিল ঠিক সেরকমই।
ঈদের ছুটি। শহরটা প্রায় ফাঁকা। তবে এই পাড়ার আড্ডা জমজমাট। পুরনো মুখেরা এসেছে। চায়ের দোকানে ভিড়। চায়ের কাপ ঘুরছে, ধোঁয়া উঠছে। কারো মুখে গানের সুর, কারো ঠোঁটে ছেঁড়া গল্প।
কিন্তু আমার মন আনচান- উচাটন। কারো কথায় কান নেই। শুধু রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। মোবাইলের স্ক্রিন বারবার চেক করছি। একবার ভাবছি কল দেবো। পরমুহূর্তে ভাবি, না থাক। আজ না হয় তাকেই আসতে দিই।
ঘড়ির কাঁটা এগোয়…
১১টা বাজে… ১২টা বাজে… ১টা…
সে এল না।
কেউ জানলো না, আমি কিছুক্ষণ পরপর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি।
কেউ জানলো না, কতবার মনে মনে বলেছি,
‘এই বুঝি ওর গাড়ির আলো। এই বুঝি সে…’
কেউ জানলো না, আমার এই আড্ডার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল- একটিবার তাকে দেখা।
ভোর রাতে আড্ডা শেষ। শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি একটা ভাঙা হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরলাম। বিছানায় শুয়ে শুধু একটাই প্রশ্ন মাথায়-
‘কোথায় গেলো সে? ভালো আছে তো?’
কখন ঘুমিয়ে গেলাম, মনে নেই।
কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তার মুখ। তার গলা। মনে হচ্ছিল, পাশে বসে বলছে —
“আপনি তো আড্ডায়, ছিলেন। একটা ফোনও দিলেন না কেন?”
ঘুমঘোরে সকাল। বেলা ১১টা।
ফোনের রিং।
চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি, স্ক্রিণে সেই নাম।
মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি।
কল রিসিভ করতেই, নরম কণ্ঠ ভেসে এলো, ওর কণ্ঠের সেই পরিচিত প্রশ্রয়,
“এখনও ঘুমাচ্ছেন বুঝি?”
আমি বললাম, “না, ঘুম থেকে উঠলাম। কেমন আছেন আপনি?”
তারপর শুরু হলো সেই চিরচেনা কথোপকথন।
ঈদের শুভেচ্ছা। কোরবানির গল্প। কে কী খেলো, কে কী পরলো।
আমি বললাম, “আড্ডায় ছিলাম।”
সে বললো, “আপনি ফোন দিলেন না কেন?”
আমি হেসে বললাম, “অনেক লোক ছিল। ব্যস্ত ছিলাম।”
ভুল করলাম।
এই বাড়তি কথার কোনো দরকার ছিল না।
আমার ওই বাড়তি বকবকানির ভিড়ে সে আর কিছু বলতে পারলো না।
আমি বুঝতে পারলাম- সে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। খুব সম্ভবতঃ অর্থনৈতিক বা পারিবারিক সমস্যা। অথবা তার নিজের জীবনের কোনো যন্ত্রণার কথা।
আমার ভুলে সে আর বললো না- বলতে পারলোনা।
ফোন রেখে মনে হচ্ছিল, একটিবার যদি আমি একটু শুনতাম! একটিবার যদি বলতাম,
“আপা, বলুন না- কী বলতে চেয়েছিলেন?”
ঠিক করলাম। বিকেলে আবার ফোন দেবো। সরাসরি বলবো,
“আপা, তখন তো ঘুমের ঘোরে ছিলাম। এখন বলুন তো, কী বলতে চেয়েছিলেন?”
সে চিন্তা মাথায় এমনভাবে ঘুরপাক খেতে লাগলো, জুম্মার আযান কখন হলো, কখন নামাজ পড়লাম- বুঝতেই পারিনি।
নামাজ শেষে দৌঁড়ে অফিসে এলাম। দরজা বন্ধ করে সিগারেট ধরালাম।
অবশেষে ফোন করলাম।
বুঝলাম, সে বাইরে। টেম্পু-রিকশার টুংটাং শব্দ পাচ্ছি।
আমি বললাম, “বাসায় না? বাইরে?”
সে বললো, “জরুরি কাজে। খালার বাসায় আসছি।”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, “কোনো সমস্যা হয়েছে?”
সে বললো, “না, এমনি। প্রয়োজন পড়লো। ফোনে বলা যাবে না। দেখা হলে বলবো।”
কয়েকবার অনুরোধ করলাম।
সে একই কথা- “ফোনে না। সামনাসামনি।”
সেদিন থেকে একরাশ অজানা টেনশন মাথায়।
কী এমন কথা? প্রয়োজন? দুঃখ? না ভালোবাসার কোনো অজানা গল্প?
শুধু জানি- অপেক্ষার আরেকটা নতুন অধ্যায় শুরু হলো।
ভালোবাসা মানে যে শুধু বলা নয়।
ভালোবাসা মানে কখনো চুপচাপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা।
ভালোবাসা মানে কখনো প্রতীক্ষায় একজোড়া চোখ খুঁজে ফেরা।
ভালোবাসা মানে মাঝে মাঝে বিনা কারণেই বুকের ভেতর হুহু করে ওঠা।
সেই রাতের আড্ডা, রাতভর উসখুস, অপূর্ণ অপেক্ষা- সবকিছুর ক্লান্তি নিয়ে ভোর পর্যন্ত জেগে ছিলাম।
সকালের ফোনটা সেই অনিশ্চয়তা খানিকটা ভাঙলো।
কিন্তু তবুও সবটুকু ভাঙলো না।
কেন ফোন দিয়েছিলো? কী বলতে চেয়েছিলো?
বলে উঠতে পারলো না।
অপেক্ষার এই বোঝা, অতিরিক্ত আশা- এসব হয়তো ওকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই ভাবলাম…
‘অতিরিক্ত আশা ছেড়ে দেবো।’
যে কথা বলার জন্য কারও অস্থিরতা নেই, তার জন্য অপেক্ষা করাও এক ধরণের বোকামি।
যদি কখনো বলে, শুনবো।
না বললে… ভালোবাসা মানে তো দাবী নয়, ভালোবাসা মানে তার ভালো থাকা।
এই অসমাপ্ত অপেক্ষা, এই না বলা কথার ভার বুকের ভেতর নিয়ে এগিয়ে যাবো।
কারণ আমি জানি…
এখানেই শেষ নয়।
একদিন দেখা হবে।
একদিন সে বলবে।
নাকি অপেক্ষার আরেকটা অধ্যায় শুরু হবে…
ভালোবাসা মানে ঠিক এমন-
একটা অসমাপ্ত গল্পের শেষটুকু জানার জন্য রাতের পর রাত অপেক্ষা করা।
Leave A Comment