কাঠঠোকরার জিভ : প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টির গল্প

পৃথিবীতে প্রকৃতি মাঝে মাঝে এমন কিছু সৃষ্টি করেছে, যার রহস্য ভেদ করা মানুষের জন্যও চমকের। এমনই এক বিস্ময়কর সৃষ্টি কাঠঠোকরার (Woodpecker) জিহ্বা। শুধু তার লম্বা জিভই নয়, এই জিভের আশ্চর্য গঠন এবং কার্যকারিতা দেখলে অবাক হতে হয়।

তুমি কি জানো, কাঠঠোকরার জিভ এতটাই লম্বা যে, সেটি ঠোঁট ছাড়িয়ে মাথার ভেতর ঢুকে, খুলির চারপাশ ঘুরে, এমনকি চোখের পাশ দিয়ে পাক খেয়ে আবার মুখের ভেতর চলে আসে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। এই বিশেষ গঠনকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Hyoid Apparatus (হায়োইড অ্যাপারাটাস)

কীভাবে কাজ করে এই জিভ?

কাঠঠোকরা যখন গাছের গায়ে ঠোকরায়, তখন তার জিভ শুধু পোকা-মাকড় ধরার কাজই করে না, বরং এটিই তার মাথার জন্য একটি প্রাকৃতিক শক-অ্যাবজর্বার হিসেবেও কাজ করে।
একজন মানুষ যদি কাঠঠোকরার মতো প্রতি সেকেন্ডে ২০ বার, প্রতি ঠোকরে নিজের মাথায় শরীরের ওজনের প্রায় ১,২০০ গুণ চাপ নিয়ে ধাক্কা খেত, তাহলে তার মাথার খুলি মুহূর্তেই ফেটে যেত। কিন্তু কাঠঠোকরা নির্বিঘ্নে এই কাজ করতে পারে, কারণ তার মাথার কাঠামো আর এই জিভের অদ্ভুত গঠন একসঙ্গে কাজ করে।

কাঠঠোকরার জিভ শুরু হয় ঠোঁট থেকে, তারপর গলার হাড়ের চারপাশ দিয়ে মাথার ভেতর ঢুকে, খুলির চারপাশ পাক খেয়ে চোখের পাশ দিয়ে আবার মুখের ভেতর চলে আসে। এই পাকানো জিভ কাঠঠোকরার মাথায় যখন ধাক্কা লাগে, তখন সেই ধাক্কার চাপ সমানভাবে ছড়িয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে শোষণ করে। ফলে মস্তিষ্কে বড় কোনো আঘাত লাগে না।

আরও আশ্চর্য তথ্য

👉 কাঠঠোকরার জিভ শুধু লম্বাই নয়, এটি আঠালো ধরনের। তাই গাছের গভীরে থাকা ছোট্ট পোকা-মাকড়ও সহজে আটকে যায়।

👉 এই জিভের গঠন আলাদা আলাদা কাঠঠোকরার প্রজাতিভেদে ভিন্ন। কেউ গাছের ছাল তুলতে, কেউ গাছের ভেতর গর্ত করে খাবার খুঁজে নিতে, আবার কেউ শুধু গাছের তলায় পড়ে থাকা পোকা ধরতে ব্যবহার করে।

👉 কাঠঠোকরার মাথার খুলির গঠনও বিশেষ। তাদের খুলির সামনের অংশ বেশি শক্ত এবং পুরু, পেছনের অংশ তুলনামূলক নরম। ফলে ঠোকরানোর সময় চাপ বেশি পড়ে সামনে, আর পেছনে থাকা জিভ ও হায়োইড অ্যাপারাটাস সেই চাপ শোষণ করে।

👉 মানুষের দেহে যদি এই কাঠামো থাকত, তাহলে হয়তো আমরা ২০ বার মাথা ঠুকেও দিব্যি কথা বলতে পারতাম!

প্রকৃতির এই অসাধারণ ডিজাইন

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে কাঠঠোকরার এই জিভের গঠন আর মাথার শক-প্রতিরোধী কাঠামো নিয়ে গবেষণা করেছেন। এমনকি আজকের দিনে মডার্ন হেলমেট ডিজাইন বা শক-অ্যাবজর্বার মেকানিজম তৈরিতে কাঠঠোকরার কাঠামো অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিই প্রমাণ করে — জীববৈচিত্র্যের মাঝে কত অসাধারণ এবং কার্যকর ডিজাইন লুকিয়ে রয়েছে, যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।