S. M. Sultan

লাল মিয়া।
চিত্রকর এস. এম. সুলতান (১৯২৩-১৯৯৪)। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে এস. এম. সুলতান নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ার এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের লোকজন শৈশবে তাঁকে লাল মিয়া বলে ডাকত। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও তাঁর পিতা ১৯২৮ সালে তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। পাঁচ বছর চলে সে শিক্ষা।

এরপর বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে সেসব দালানের ছবি অাঁকা। এর আগে দশ বছর বয়সে স্কুল পরিদর্শনে আসা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ছবি এঁকে তাঁর চোখে পড়েছিলেন। সুলতানের ইচ্ছা ছিল সম্ভব হলে কলকাতায় গিয়ে ছবি অাঁকা শিখবেন। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি সে ইচ্ছার পথে ছিল বড় বাধা। এসময় এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এস. এম. সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান।

কলকাতায় এসে তিনি ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতেই ওঠেন। ইচ্ছা ছিল কোনো কাজ জোগাড় করে অর্থ উপার্জন এবং একই সাথে শিল্প শিক্ষা। এ সময়ই তিনি প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন।

সুলতানের জন্য সোহরাওয়ার্দী তাঁর গ্রন্থাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং তাঁকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। ১৯৪১ সালে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, যদিও ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা তাঁর ছিল না। এ ব্যাপারে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান ছিল মুখ্য। তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়াশোনার পর তিনি বেছে নেন একজন ফ্রি-ল্যান্স শিল্পির জীবন।

আর্ট স্কুলের বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার রীতিনীতি তাঁর সহজাত বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছিল। সুলতান ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ছিলেন ভবঘুরে বা ছন্নছাড়া। তিনি প্রকৃতিকে ভালবাসতেন একজন রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে এবং সেরকম তীব্রতা নিয়েই তিনি অস্বীকার করেছেন যান্ত্রিকতা-পিষ্ট নগর ও নাগরিক জীবনকে। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে পথে।

তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ছোট বড় শহরগুলিতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে ও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেছেন এবং প্রদর্শনীও করেছেন। শিল্পি হিসেবেও তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে ছিল পার্থিব বিষয়ের প্রতি অনীহা এবং কোনো এক স্থানে শিকড় ছড়িয়ে বসার প্রতি তীব্র অনাগ্রহ। এ কারণে তখনকার অাঁকা ছবির নমুনা, এমনকি ফটোগ্রাফও এখন আর নেই। তবে সে সময় প্রধানত তিনি নিসর্গ দৃশ্য এবং প্রতিকৃতি অাঁকতেন। কাশ্মীরে কিছুদিন থেকে তিনি অনেক ছবি এঁকেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সিমলায় তাঁর অাঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়।

দেশ বিভাগের পর সুলতান কিছুদিনের জন্য দেশে ফেরেন। কিন্তু তারপরই ১৯৫১ সালে করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুবছর কাজ করেন। এ সময়ে চুঘতাই ও শাকের আলীর মতো শিল্পিদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ইতঃপূর্বে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পিদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি আমেরিকা যান এবং নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন এবং এরপর লন্ডনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী করেন।

১৯৫৩ সালে আবার নড়াইল ফিরে তিনি শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। শিশুদের নিয়ে সুলতানের অনেক স্বপ্ন ছিল। শেষ বয়সে নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এর কিছু বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নড়াইলে তিনি নন্দন কানন নামের একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় যখন আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক কাজ হচ্ছে এবং প্রচুর উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে শিল্পিরা শৈলী নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, মিডিয়া নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তখন সকলের দৃষ্টির আড়ালে তিনি নড়াইলেই রয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন, কিন্তু তাঁর জীবনের মূল সুরটি বাঁধা ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে। সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জীবনের প্রধান উৎসকেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্ল­ব ও সংগ্রাম এবং নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস এবং অনুপ্রেরণা। তিনি কৃষক পুরুষের শরীরকে করেছেন পেশীবহুল এবং বলশালী, কৃষক রমণীর শরীরকে এঁকেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নে, তাকে দিয়েছেন যুগপত লাবণ্য এবং শক্তি। হয়তো জীবনে কৃষকায়, ম্রিয়মাণ কৃষকদের দেখে দেখে কল্পনার নির্মাণে তাদের তিনি দিয়েছেন শক্তি ও স্বাস্থ্য। তবে সুলতানের ছবিতে পরিপূর্ণতা এবং প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি আছে শ্রেণির দ্বন্দ্ব, এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতার চিত্রও। হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) ও চরদখল (১৯৮৮) এরকম দুটি ছবি।

১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতান শিল্পরসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যান। মধ্য সত্তরে তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় থেকে তিনি কিছু ছবি অাঁকেন এবং ১৯৭৬ সালে সেসব ছবি দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বস্ত্তত, এ প্রদর্শনীটিই তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ ছবিগুলিই সুলতানকে নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতিনিধি এবং তাদের নন্দনচিন্তার একজন রূপকার হিসেবে উপস্থাপিত করল। তাঁর ছবিতে গ্রাম হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র এবং কৃষকই হচ্ছে প্রকৃত জীবন শিল্পি। গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন তাঁর সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। এজন্য কৃষক ও কৃষকের জীবন একটা কিংবদন্তীর শক্তি নিয়ে উপস্থিত তাঁর ছবিতে।

চর দখল (বোর্ডের উপর তেলরঙ), ১৯৭৬
তাঁর কাজে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পিদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে। সুলতানের মতো কেউ আধুনিকতার এরকম ব্যাখ্যা দেননি। তাঁর স্টাইলের ক্ষেত্রে তিনি অননুকরণীয়। তাঁর কোনো অনুসারী বা স্কুল নেই, কারণ তাঁর মতো মৃত্তিকা সমর্পিত জীবন তাঁর সময় আর কোনো শিল্পি যাপন করেননি। সুলতান তেলরঙ ও জলরঙের ছবি এঁকেছেন, ব্যবহার করেছেন সাধারণ কাগজ, সাধারণ রং ও চটের ক্যানভাস। এজন্য তাঁর অনেক ছবির রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেদিকেও তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
সুলতান আশির দশক থেকে নড়াইলে থেকে যেতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর কাছে আশ্রয় নেওয়া মানুষ, শিশু এবং জীবজন্তুর প্রতি তাঁর ভালবাসার জন্য তাঁর বাড়িটিকে এদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটি চিড়িয়াখানা ছিল তাঁর। শিশুদের জন্য একটি বিরাট নৌকাও বানিয়েছিলেন।

১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের আরেকটি প্রদর্শনী হয়। আশির শেষ দিকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে, ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোন-এ তাঁর শেষ প্রদর্শনীটি হয়। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর, যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

[সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম] [পোস্টে ব্যবহৃত ছবিটি গুগল ইমেজ থেকে নেওয়া]

শিল্পী এস. এম. সুলতান সম্পর্কিত একটি ডকুমেন্টারী (আদম সুরতঃ তারেক মাসুদ) দেখতে ক্লিক করুন

AliDropship is the best solution for drop shipping________________________________________

শেয়ার করতে পারেন।
ধন্যবাদ
www.compuartsdigital.com
________________________________________


====================================================================
সকল সংবাদপত্রগুলির লিংক
====================================================================
প্রয়োজনীয়, জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু যোগাযোগ নম্বরের লিংক
====================================================================
শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য, পুরষরা উঁকি দিতে চেষ্টা করবেন না . . . ২
====================================================================
অভ্র বা বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইন্টারনেট জগতে অতি সহজে বাংলা লেখার উপায় . . .
====================================================================
যারা অভ্রতে লেখেন তারা ক্লিক করতে পারেন লিংকটিতে
====================================================================
একহাজার . . . একটি টিপস
====================================================================
ঘুরে আসুন ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়ার ডীপ ওয়েব, ডার্ক ওয়েব সাইটগুলো থেকে।
====================================================================
ইংরেজি বিষয় সহ জেনে নিন প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ, মজার কিছু তথ্য . . . ১