📖 শিক্ষকের চোখে ছাত্রের স্বপ্ন

ভূমিকা

একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্র-ছাত্রীই সবচেয়ে বড় সম্পদ। শুধু পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একজন শিক্ষক তার ছাত্রের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা। একজন প্রকৃত শিক্ষক ছাত্রের ভেতরকার প্রতিভা, আগ্রহ, এবং স্বপ্নকে খুঁজে বের করে, সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আজকের এই লেখায় আমি এমন এক অভিজ্ঞতার কথা বলব, যেখানে একজন ছাত্রের স্বপ্ন এবং একজন শিক্ষকের দায়িত্ব কতটা গভীর হতে পারে — তা বোঝার চেষ্টা করব।

শিক্ষণীয় একটি গল্প

আমার স্কুলের এক ছাত্রের কথা বলি। নাম অনিক (ছদ্মনাম)। গ্রামের ছেলে। আর্থিক অবস্থাও বেশ টানাটানির। তার বাবা মাছ ধরে বিক্রি করে। মাছ বিক্রেতা। মা গৃহিণী। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম তাদের পরিবারে নিত্যদিনের ঘটনা।

কিন্তু ছোট্ট অনিকের এক অন্যরকম আগ্রহ— আঁকাআঁকি। ক্লাসের খাতার পেছনে, বইয়ের কোনায়, দেয়ালে, মাঠের মাটিতে সে ছবি আঁকতো। আমি যখন একদিন তার খাতায় পেছনের পাতায় করা একটা ছোট্ট ছবি দেখি— তাজমহলের একটা রঙিন রূপরেখা— তখন তাকে ডেকে নিয়ে আসি।

জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি ছবি আঁকতে ভালোবাসো?”
সে মাথা নেড়ে বলে, “স্যার, খুব ভালোবাসি। বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হব। কিন্তু আব্বা-আম্মা চান, চাকরি করব।”

তার কথায় এক আশ্চর্য মায়া কাজ করলো। বুঝলাম, এই ছোট্ট ছেলেটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক স্বপ্নবাজ। সেই দিন থেকে স্কুল শেষে মাঝে মাঝে তাকে ডেকে নিই, রঙ-পেন্সিল দিই। সপ্তাহে দু’দিন করে ড্রইং শেখাতে শুরু করলাম।

মাঝে মাঝেই সে বলে, “স্যার, বড় হয়ে আমি আপনার মতো হব। ছাত্রদের আঁকাআঁকি শেখাব।”
এই একটা কথায় আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল বহুগুণ।

শিক্ষকের ভূমিকা আসলে কী?

অনেকের ধারণা, শিক্ষক মানে শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়া পড়ানো, পরীক্ষার খাতা দেখা আর নম্বর দেওয়া। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষক হলেন সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গঠনশিল্পী।

শিক্ষকের হাতে গড়া প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীই ভবিষ্যতের নাগরিক। সে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, শিল্পী হবে, লেখক হবে— এই পথ তৈরি করার দায়িত্বও শিক্ষককেই নিতে হয়।

ছাত্রের মুখে যখন সে তার স্বপ্নের কথা বলে, তখন তা শুধু এক কথার গল্প নয়। তা একটি ভবিষ্যতের কথা। সেই স্বপ্নের প্রদীপটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শিক্ষকই পারে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে।

ছাত্রের স্বপ্ন কখন মরে যায়?

আমাদের সমাজে এখনো অনেক জায়গায় দেখা যায়, ছেলেমেয়েরা তাদের নিজের ইচ্ছামতো পেশা বা স্বপ্নের কথা বললেই বাধা আসে। “ওসব দিয়ে কি হবে?”, “বড় হয়ে চাকরি করো”, “ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হও” — এই কথাগুলোই তাদের ভেতরের আগুনকে নিভিয়ে দেয়।

শুধু পরিবার নয়, কখনো কখনো স্কুলও এই দমিয়ে দেওয়ার কাজে অংশ নেয়।

তবে একজন শিক্ষক যদি ছাত্রের ভেতরের সেই আগ্রহটাকে বুঝতে পারেন, সেই আগ্রহকে উৎসাহ দেন, তবে অনেক কিছুই বদলে যায়।

আমি কী শিখলাম?

আমি নিজেও একসময় ভেবেছিলাম, শুধু ভালো রেজাল্ট করলেই একজন ছাত্র সফল। কিন্তু এই অনিকের মতো ছাত্রদের দেখে উপলব্ধি করেছি, রেজাল্টের চেয়ে বড় বিষয় তার স্বপ্ন।

সে যেটা হতে চায়, সেটাই তাকে মোটিভেট করে। পড়ালেখার পাশাপাশি তার সেই আগ্রহটাকে জাগিয়ে রাখলে সে ভালো পড়াশোনাও করবে।

শেষ কথা

আজকের দিনে যখন অনেকে শুধু পরীক্ষার নম্বর, এ গ্রেড, জিপিএ-৫ নিয়েই ব্যস্ত — তখন আমাদের উচিত ছাত্রদের স্বপ্ন দেখার সাহস দেওয়া।

আমরা যদি শুধু পড়াই না, বরং তাদের আগ্রহ, স্বপ্ন আর প্রতিভার পেছনে একটু সময় দিই, তবে আমাদের সমাজ পাবে সত্যিকারের ডাক্তার, প্রকৌশলী, চিত্রশিল্পী, লেখক, শিক্ষক, এবং সুনাগরিক।

আসুন, আমরা শিক্ষকরা শুধু পড়াই না — স্বপ্ন দেখাতেও সাহায্য করি। ছাত্রের চোখের আলো নিভিয়ে না দিয়ে, বরং স্বপ্নকে উজ্জ্বল করে তুলি।