১৯৯২ সালের কথা। জামালপুর জেলার বয়ড়া ইসরাইল আহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়। এক সময়ের খ্যাতনামা সেই স্কুলের ক্লাসরুম, খেলার মাঠ, আর ছেলেমেয়েদের কোলাহলে দিনভর মুখর থাকতো। তখনকার সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী, দৃঢ়চিত্ত আর দায়িত্ববান প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব মোঃ আব্দুস ছালাম স্যার। স্যারের বাড়ি ছিলো স্কুলের একটু পূর্ব দিকে। সেই এলাকায়ই থাকতো এক ছেলেও, নাম হারুন-অর-রশীদ।
হারুন ছিলো ১৯৯১ সালের পরীক্ষার্থী। কোনো এক অজানা কারণে সে ১৯৯২ ব্যাচে আবার নাম লেখায়। কেনো বা কীভাবে, সেটা আজ আর ঠিক মনে পড়ে না। সে বছর পরীক্ষা দিয়েছিলো কি না, সেটাও আজ অন্ধকার। তবে একটা জিনিস দিব্যি মনে পড়ে — ছেলেটা প্রচলিত পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলো না। সে, আর তার বন্ধু আনোয়ার (পরে বিজিবিতে যোগ দেয়), ওদের হাতের লেখা ছিলো এমন, নিজেরাই পড়তে পারতো না। এ নিয়ে ক্লাসের সবার হাসাহাসি, টিপ্পনী ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা।
কিন্তু হারুনের ছিলো এক অপার্থিব প্রতিভা। যা আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে।
ছেলেটা অসাধারণ ছবি আঁকতো। এমন না যে ওর আঁকাটা প্রচলিত বইয়ের মতো বা শিল্পশিক্ষকের শেখানো নিয়মে। বরং ওর আঁকার মধ্যে ছিলো এক দুর্দান্ত ভিন্নতা, এক রকম উন্মুক্ত আবেগ আর মায়া। পুরো খাতা জুড়ে নীল কালো কালি দিয়ে ইকোনো-ডিএক্স পেন দিয়ে এঁকে রাখতো অবিশ্বাস্য সব স্কেচ। বাংলা বিষয়ের গদ্য বা পদ্যের উত্তর লেখার বদলে ও ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিতো গল্পের মর্মার্থ। তিন-চার পাতাজুড়ে এঁকে ফেলতো চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনা।
আমি প্রায়শই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ছোট্ট হারুনের সেই সৃষ্টির দুনিয়ায় হারিয়ে যেতাম। যেন এক অসম্ভব সৌন্দর্যের খেলা। অথচ সেই সময়ের হারুন জানতো না তার এই প্রতিভার মূল্য কতটুকু, কিংবা কোথায় গেলে এই প্রতিভার যোগ্য মূল্যায়ন হতে পারতো।
স্কুল জীবনের সেই দিনগুলো কেটে গেলো। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হই। দ্বিতীয় বর্ষে যখন টোন, হাফশেড, ক্রসটোন, সিলভারটোন শেখার ক্লাসে যাই — স্যারের বোর্ডে আঁকা, বন্ধুদের অনুশীলন আর শেখার কৌশল দেখে আমার বারবার মনে পড়ে সেই হারুনের কথা। কী আশ্চর্য মিল! হারুন যেন দশ বছর আগেই এসব জানতো। ওর আঁকায় ঠিক এমনই টেকনিক ছিলো। আলোছায়া, পার্সপেক্টিভ, কম্পোজিশন, ব্যাকগ্রাউন্ড হ্যান্ডেল করা — সে সময় আমরা জানতামই না এগুলো কী।
আমরা তখন তো জানতামই না দেশে কোনো চারুকলা অনুষদ আছে, কিংবা ছবি আঁকা শেখার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়! বিটিভির রূপনগর নাটক আর ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাসেই ছিলো আমাদের জানা দুনিয়া। তারপর জামালপুরের এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে তৌকির আহমেদের মুখে জানলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা নামের এক বিদ্যাপীঠ আছে। সেই জানতে জানতেই হারুনের আঁকার নিয়ম আমি তখনও শিখে উঠতে পারিনি। অথচ হারুন তার আঁকায় এমন সব নিয়ম-কানুন, কম্পোজিশনের মায়া সৃষ্টি করে রেখেছিলো, যা আমি শিখেছি তার বহু বছর পর।
এখনো অনেকদিন রাতে নিঃশব্দে ভাবি — “হারুন তুই কোথায়?”
আজও হয়তো তুই আঁকিস কিনা জানিনা। বেঁচে আছিস তো? যদি এই লেখা কোনোভাবে তোর চোখে পড়ে — জানিস, তোর সেই ছবি আঁকার দুর্দান্ত প্রতিভা ছিলো, আছে। তোকে তখন বলতে পারিনি, আজ বলছি — তোর মতো প্রতিভা খুব কম মানুষ পায়। তোকে হারিয়ে ফেলা মানে এক বিস্ময়কর শিল্পীকে সমাজের অজানা অন্ধকারে ফেলে দেওয়া।
তোর খোঁজ আমি রাখবো। হয়তো আবার কোনোদিন দেখা হবে — তোর আঁকা ছবি নিয়ে বসে মুগ্ধ হয়ে যাবো আগের মতো।
শেষ কথা:
কেউ কেউ জন্মায় সত্যিই ভিন্ন কোনো আলো নিয়ে। সমাজের প্রচলিত মেধা, পড়াশোনার গ্রেড, মার্কশিট দিয়ে সব প্রতিভার বিচার হয় না। কেউ বই পড়ে বড় হয়, কেউ আঁকতে আঁকতে। কেউ গদ্যে উত্তর দেয়, কেউ ছবিতে গল্প বলে। হারুন ছিলো তেমনই এক বিরল প্রতিভা।
তাদের খুঁজে বের করাই আমাদের, শিক্ষকদের দায়িত্ব। আজও হারুনের মতো হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রতিভা বাংলার মফস্বলের স্কুলঘরের শেষ বেঞ্চিতে বসে আছে — একটু ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা আর সঠিক দিকনির্দেশনার অপেক্ষায়।
Leave A Comment