ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার একটি ‘শ্রোতা জরিপে’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৬তম স্থানে আসেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সর্বপ্রথম যুক্তি-তর্ক দিয়ে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিবেচিত করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণ এবং বাঙালির চেতনা বিকাশের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৪ পরগনার পেয়ারা গ্রামে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১১ জুলাই। তাকে বলা হতো ‘চলন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া’।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠক সমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসংগ্রামী। ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। ১৮টি ভাষার ওপর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল এ ভাষাবিদের।
পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করার পর ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে যান। কলকাতা মাদ্রাসার একটি ইউনিট তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখান থেকে এফএ (বর্তমান এইচএসসি সমমান) পাস করার পর ১৯১০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি এমএ এবং আইন পড়েন। ১৯২৮ সালে প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। ডক্টরেট শেষ করার আগেই তিনি গবেষণার কাজ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত সিতাকুন্ডু উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কিছুদিন ওকালতি পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি বশিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাঙলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক ও রিডারের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শহীদুল্লাহ হলের নাম ছিল ‘ঢাকা হল’।
১৯৪৪ সালে কয়েক বছর বগুড়া কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করার পর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আবার ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ১৯৫৮/৫৯ পর্যন্ত। তিনি করাচিতে উর্দু অভিধান বোর্ডের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’ দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স পদক’ও মরণোত্তর হিলাল-ই-ইমতিয়াজ খেতাব প্রাপ্ত হন তিনি। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
তার জীবদ্দশায় বহু ভাষা শিখেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পরে তিনি বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান তৈরি করেন। বাংলা একাডেমির ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদেও কাজ করেছিলেন। এছাড়াও বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি হিসেবে তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
এমএ পাস করার পর জার্মানিতে গিয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেখানে জার্মান, ফরাসিসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষাও শিখেছিলেন। এছাড়া বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা লাভ করেছিলেন।
তিনিই প্রথম ১৯৪০ সালে ভারতের মুসলিম শিক্ষা কংগ্রেসে পূর্ব বাঙলায় ভাষা চর্চা উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রস্তাব করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ সম্মেলনে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাংলা একাডেমী’ রাখার প্রস্তাব করেন।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি লেখার মধ্যে দিয়ে। কমরেড পত্রিকায় ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট অর্থাৎ ১৪ আগস্টের ১১ দিন আগে তিনি লেখেন, ‘দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ প্রবলেম অব পাকিস্তান’। এই নিবন্ধে তিনি বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশে, যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতারই নামান্তর।
‘এই কথাটাই দেশে তখনকার বাঙালি সুধী সমাজ লুফে নেন এবং এই কথাটার ওপরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা।’
ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদানের জন্য সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদুল্লাহ হল’।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলা সাহিত্যের কথা (দুই খণ্ড)’ এবং ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’। তাঁর অন্যতম কালজয়ী সম্পাদনা গ্রন্থ বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। তিনি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’সহ আরো অনেক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। শিশু পত্রিকা ‘আঙুর’ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক অনুবাদ এবং নানা মৌলিক রচনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একসময় বিদ্যাপতির পদগুলো সম্পাদনা করেছিলেন। তার একটি বিরাট কৃতিত্ব হচ্ছে প্রাচীন বাংলার যে প্রথম চর্যাপদের সম্পাদনা।
ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর স্ত্রীর নাম ছিল মরগুবা খাতুন। তারা সাত পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন। জীবন সায়াহ্নে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ৮৪ বছর বয়সে পরপারে চলে যান। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তাকে দাফন করা হয়। তিনি বাঙালি জাতিকে বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষার রচনাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে গেছেন।

________________________________________


আপনার ব্লগ দেখতে ক্লিক করুন এখানে

আপনার বয়স সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর পেতে ক্লিক করে সহযোগিতা নিন এখান থেকে


====================================================================
সকল সংবাদপত্রগুলির লিংক
====================================================================
প্রয়োজনীয়, জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু যোগাযোগ নম্বরের লিংক
====================================================================
শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য, পুরষরা উঁকি দিতে চেষ্টা করবেন না . . . ২
====================================================================
অভ্র বা বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইন্টারনেট জগতে অতি সহজে বাংলা লেখার উপায় . . .
====================================================================
যারা অভ্রতে লেখেন তারা ক্লিক করতে পারেন লিংকটিতে
====================================================================
একহাজার . . . একটি টিপস
====================================================================
ঘুরে আসুন ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়ার ডীপ ওয়েব, ডার্ক ওয়েব সাইটগুলো থেকে।
====================================================================
ইংরেজি বিষয় সহ জেনে নিন প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ, মজার কিছু তথ্য . . . ১