Untitled-12

শিক্ষা ও নৈতিকতা

মানব সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই নৈতিকতার ধারণা রয়েছে। বস’ত মানুষ একটি নৈতিক প্রাণী। মানুষকে নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নৈতিক জবাবদিহীতা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য প্রধানত নৈতিক। জৈবিক দিক মানুষসহ সব জীবেরই রয়েছে কিনা নৈতিক দিক শুধু মানুষেরই আছে। এদিক দিয়ে মানুষ অনন্য। সব সমাজে ও সব ধর্মে নৈতিকতার গুরুত্ব স্বীকৃত। নৈতিকতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বের দাবীদার একটি দেশের শিক্ষা ব্যবসা। শিক্ষা ব্যবসা যদি নৈতিকতার উন্নয়নের সহায়ক না হয় তাহলে সে শিক্ষার মাধ্যমে মানবজাতির সত্যিকার কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। তাই নৈতিকতার উন্নয়নে শিক্ষা ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম।

নৈতিকতার ধারণা

নৈতিকতা বলতে মুলতঃ আমরা বুঝি মানুষ অন্যদের – মানুষ ও মানবজাতি  বহির্ভূতদের সাথে কীভাবে আচরণ করে তার নির্যাস ও রূপরেখা । অন্যান্যদের সাথে পারস্পরিক কল্যাণ, প্রবৃদ্ধি, সৃজনশীলতার উন্নয়নে কিভাবে মানুষ আচরণ করে এবং কীভাবে মন্দের পরিবর্তে  ভালো, ভুলের পরিবর্তে শুদ্ধতার  জন্যে প্রয়াস চালায় নৈতিকতা তারই নির্দেশনা দেয়। নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের রয়েছে এক পূর্ণাঙ্গ ধারণা যা মানবজাতির নৈতিকতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

ইসলামে চরিত্র বা নৈতিকতাকে বুঝাতে সাধারণত আখলাক (খুলুক শব্দের বহু বচন), হুসনুন খূলুক, আদব শব্দত্রয়  ব্যবহৃত হয়। ‘খুলুক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক গঠন, স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি, মেজাজ, নৈতিকতা ইত্যাদি। আর এর বহুবচন আখলাক শব্দের অর্থ হচ্ছে চরিত্র,  নৈতিকতা। হুসনুন খুলুক শব্দগুচ্ছ দ্বারা বুঝায় ঃ সুন্দর স্বভাব, সচ্ছরিত্র, সৎস্বভাব, উন্নত স্বভাব-চরিত্র ইত্যাদি। আদব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মার্জিত আচরণ, পরিশীলিত অবস’া, সংসৃ্কতিবোধ, সামাজিক নিয়মানুবর্তীতা, নিয়মানুগ আচরণ ইত্যাদি।

পরিভাষা হিসেবে আদব শব্দটি মানসম্মত নিয়মনীতি ও আচরণকে বুঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া এটি শৃংখলা, নিয়মানুগ বা মার্জিত ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ, রীতি নীতি এবং প্রশিক্ষণকেও বুঝায়।

সাধারণভাবে আদব বলতে নিজের ও  পরিবারের সদস্যদের এবং সমাজ ও সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের সাথে কোন ব্যক্তির প্রকৃত অবস’ান সাপেক্ষে শৃংখলা ও নিয়মসিদ্ধ আচরণকে বুঝায়। এছাড়াও এর দ্বারা বিশেষ কোন কাজ সম্পাদন উপলক্ষে যে সমস্ত  মানসম্পন্ন রীতি-নীতি মেনে চলা হয় তাও বুঝানো হয়।

আদবের পরিপন্থী আচরণ হচ্ছে সঠিক ও ন্যায়ানুগ আচরণের বিপরীত বিষয়। বস্তুত আখলাক বা হুসনুন খুলুক শব্দ দ্বারা  প্রধানত সৎ স্বভাব- উন্নত চরিত্র এবং আদব দ্বারা প্রধানত বাহ্যিক মার্জিত  ও সামাজিক নিয়মানুগ, বাঞ্চিত -কাঙ্ক্ষিত আচরণ বুঝায়। এ সকল শব্দসমূহ দ্বারা সমষ্টিগতভাবে উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতা এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য  আচরণকে বুঝানো হয়।
ইসলাম নৈতিকতার এমন এক মান নির্ধারণ করেছে যা সর্বাবস্থায় প্রয়োগযোগ্য। যা ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও  ব্যক্তিগত -সামাজিক পক্ষপাতিত্বমুক্ত।  ইসলামী নৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়।

মহানবী সা. বলেছেন,

“তুমি আল্লাহকে ভয় করো (তাকওয়া অবলম্বন করো )। কেননা  তা তোমার সমস্ত কিছুকে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে দেবে । (বায়হাকী, শুয়াবিল ঈমান)-

এর অর্থ হচ্ছে একজন ব্যক্তি কোন সামাজিক চাপে পড়ে বা ব্যক্তিগত-সমষ্টিগত কোন স্বার্থের কারণে নয়, অথবা কোন পার্থিব ভয় বা প্রলোভনের কারণে নয় বরং একমাত্র তার স্রষ্টাকে ভয় করে এবং তাঁর সন্তোষ বিধানের লক্ষ্যেই সে তার সমস্ত- কার্যক্রম সম্পাদন করবে। সমস্ত অন্যায় ও মন্দ থেকে বিরত থাকবে। ভালো কাজ সম্পাদন করবে। ইহাই ইসলামের সৌন্দর্য্য। এর নামই ইসলামী নৈতিকতা। এ হাদিস আরো স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে যে তাকওয়াই হচ্ছে সবকিছু সুন্দর করার, চারিত্রিক উৎকর্ষতা ও যথাযথ নৈতিকতা অর্জন করার প্রকৃষ্ট উপায়। এক্ষেত্রে তার দুনিয়ার সুবিধা অর্জিত হউক বা না হোক তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। সে প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি স্বীকার করে হলেও নৈতিক মান রক্ষা করে চলবে। এর সাথে সাথে ইহসানও ইসলামী নৈতিকতার অন্যতম মানদন্ড। সৎ নিয়্যাত, ন্যায়বিচার, ভালোবাসা, দয়া, ভ্রাতৃত্ব, মধ্যপন’া, পাপ ও অপরাধ থেকে মুক্ত থাকা, নিজের  বা অন্য কারো ক্ষতি না করা, মানবতাবোধ, দায়িত্ববোধ, সেবাধর্মী ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদন ইত্যাদির নাম ইহসান। ইসলাম তাকওয়া ও ইহসানের ভিত্তিতে অত্যন্ত উচ্চমানের এক নৈতিক আদর্শ গড়ে তুলতে চায়। বস’ত তাকওয়া ও ইহসান নৈতিক উৎকর্ষতার উচ্চ মার্গে পৌঁছার প্রকৃষ্ট পথ। ইসলাম সে পথেই মানবজাতিকে আহ্বান জানায়।

আল কুরআনে আছে,

“আল্লাহ তোমাদেরকে আদল ও ইহসানের নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সুরা নাহল, ১৬ঃ৯০)

আদল হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা যার ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়। আদল হচ্ছে কর্তব্য বা  নৈতিকতার সীমা যা অবশ্যই পালন করতে হবে। আর ইহসান হচ্ছে কর্তব্যের চেয়েও এক ধাপ উপরে। যা নৈতিক মানকে উচ্চ মার্গে পৌঁছিয়ে দেয়। বস’ত তাকওয়া ও ইহসানের ভিত্তিতে গড়ে উঠে ইসলামে নৈতিকতা। আর ইসলামী নৈতিকতার প্রেরণা ও চুড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ঃ আল্লাহর সন’ষ্টি অর্জন ও ঐশী মুক্তি লাভ। এটি এমন এক লক্ষ্য যা মানুষকে উন্নীত করে উৎকর্ষতার উচ্চতম স্তরে। আশা করা হয় মানুষ এ লক্ষ্যেই কাজ করবে। তাহলেই ব্যক্তি ও সমাজ উন্নত নৈতিকতার ভাবধারায় উদ্ভাসিত হবে ।

ইসলামী নৈতিকতার নীতিমালা ইসলাম নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে   কতকগুলো সুস্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে  যেগুলোর আলোকে নৈতিকতার উন্নত মান নির্ধারণ করা যায়। সেগুলো প্রধানত নিম্নরূপ-
ক) মহৎ উদ্দেশ্য – উদ্দেশ্য, সংকল্প বা ইচ্ছের উপর নৈতিক কাজের ফলাফল নির্ভরশীল

হাদিসে আছে, মহানবী সা. বলেছেন-

“নিয়্যাতের উপর আমল বা কাজের ফলাফল নির্ভরশীল।” (বুখারী)

অর্থাৎ কোন কাজ ভালো উদ্দেশ্যে করা হলেই তা নৈতিক হবে। যদি আপাত ভালো কাজও মন্দ উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে তাকে সৎকর্ম বলা যায় না। অন্য দিকে মনে খারাপ উদ্দেশ্য নেই কিন’ ঘটনাক্রমে কোন মন্দ কাজ সংঘটিত  হয়ে গেল তাহলে তার জন্যে তা নৈতিক অপরাধ হবে না।
খ) উদ্দেশ্য এবং কার্যপদ্ধতি উভয়টি সঠিক হতে হবে ঃ ইসলামী নৈতিকতার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে যে শুধু উদ্দেশ্য  মহৎ হলে চলবে না, কাজের পদ্ধতিও সঠিক ও ন্যায়সংগত হতে হবে। “উদ্দেশ্য মহৎ হলেই যেকোন পদ্ধতিই গ্রহণ করা যেতে পারে।”  ইসলাম কখনও এধরনের  নীতি সমর্থন করে না। ইসলামের নৈতিক দৃষ্টিকোণ হচ্ছে উদ্দেশ্য যেমন ভালো হতে হবে তেমনি কাজ সম্পাদনের পদ্ধতিটাও ভালো হওয়া জরুরী। মন্দ কাজ ভালো উদ্দেশ্যে করলেও কিন’ তা নৈতিক অপরাধই হবে ।
গ) স্বাধীনতা ও দায়িত্ব পরস্পর পরিপূরকঃ  ইসলাম মানুষকে  একদিকে স্বাধীনতা দেয় অন্যদিকে তাকে দায়িত্বশীল হতেও বলে।

মহানবী (সা.) বলেছেন,

“তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল” (বুখারী)।

কাজেই দায়িত্বমুক্ত স্বাধীনতা বলে কোন বস’র স্বীকৃতি ইসলামে  নেই। যেখানে কাজের স্বাধীনতা থাকবে সেখানে কাজের দায়িত্বশীলতাও  থাকতে হবে।  আর তা না হলে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিতে বাধ্য। কাজেই স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা অবশ্যই পরস্পর পরিপূরক।

ঘ) সর্বাবস’ায় ন্যায়ের উপর থাকতে হবেঃ

পবিত্র কুরআনে আছে

“আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় ও ইনসাফ এবং ইহসানের নির্দেশ দিচ্ছেন।” ( সুরা আন নাহল, ১৬/ ৯০)।

অন্যত্র আছে,

“ —–  আর মিযান নাযিল করেছি যেন মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। —”(সুরা হাদিদ, ৫৭ /২৫)।

আল কুরআনের আরেক জায়গায় আল্লাহ স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন,

“মানুষের মধ্যে যখন ফায়সালা করবে তখন ন্যায়ের সাথে করবে।” (নিসা, /৫৮)।

কাজেই  সর্বদা ন্যায়ের উপর থাকা ও সর্বত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী নৈতিকতার অন্যতম মূলনীতি।

“আর অন্যায়ের বিনিময়ে ততটুকু অন্যায়, যতটুকু অন্যায় করা হয়েছে। তবে যে মাফ করে দেয় এবং সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট। –” (সুরা শুরা/ ৪৪)

অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে

“এবং কোন দলের শত্রুতা যেন তোমাদের এতটুকু ক্ষিপ্ত না করে যাতে তোমরা ন্যায়ের পরিপন্থী কাজ করে বসো। তোমরা ন্যায় বিচার করো, তা তাকওয়ার নিকটবর্তী।” (আল মায়েদা,  ৫/৮)।

কাজেই ন্যায়নীতি উপর থাকা ও তাকে প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের অন্যতম নীতি ।

ঙ) মানবিক ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য সংরক্ষণ-

মহানবী সা. বলেছেন,

“সমস্ত সৃষ্টিজগত আল্লাহর পরিবার, আল্লাহর নিকট সেই সর্বাপেক্ষা প্রিয় যে তাঁর (আল্লাহর)  পরিবারের প্রতি ভালো ব্যবহার- সদাচরণ (ইহসান) করে।” (বায়হাকী, শুয়া’বুল ঈমান)

কাজেই ইসলাম চায় মানুষ মানুষের প্রতি ভাই হিসেবে মানবিক আচরণ করুক। কেননা, গোটা মানবজাতিকে আল্লাহ একটি পরিবার থেকে সৃষ্টি করেছেন।

কুরআনে আছে,

“হে মানুষ আমরাই তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর তোমাদিগকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরের সহিত পরিচিত হতে পারো। বস’ত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নীতিপরায়ণ বা মুত্তাকী।” (হুজরাত, ৪৯ /১৩)।

কাজেই দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই উৎস থেকে সৃষ্ট। কাজেই মানুষ হিসেবে কেউ উৎকৃষ্ট কেউবা নিকৃষ্ট নয়। সবাই সমান। পার্থক্য হতে পারে শুধু বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে যে আল্লাহকে বেশী ভয় করে সেই সর্বাধিক সম্মানিত। কাজেই মানবজাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা ইসলাম দিয়ে থাকে। যাবতীয় বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, জাত্যাভিমান  ইত্যাদির কোন স’ান নেই ইসলামে। ইসলামী নৈতিকতার ক্ষেত্রেও মানবজাতির এ সাম্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বস’ান দখল করে আছে।

চ) বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে গৌণ ক্ষতি স্বীকার করা যেতে পারে ঃ এটি ইসলামী আইন ও নীতিশাস্ত্রের অন্যতম মূল নীতি। মানবজাতির কল্যাণ ইসলামের একমাত্র লক্ষ্য। তবে সব সময় নিরবচ্ছিন্ন কল্যাণ সম্ভব হয় না। বাস্তবে দেখা যায় যে বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে ক্ষতি স্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না। বস’ত সমষ্টির কল্যাণের জন্যে ব্যষ্টির ক্ষতি স্বীকার করা যেতে পারে। যেখানে কিছু কিছু ছোট ক্ষতি স্বীকার না করলে বড় ধরনের কল্যাণ অর্জনে সমস্যা সৃষ্টি হয় সেসব ক্ষেত্রে ক্ষতি স্বীকার করে হলেও বৃহত্তর কল্যাণের বিষয়টিকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।

ছ) চরম ও নরম উভয় পন’া পরিহার করতে হবে ঃ ইসলাম মানুষকে মধ্যমপন’ী হতে বলেছে। যাবতীয় বাড়াবাড়ি করতে নিষিদ্ধ করেছে। অতীতে ইহুদী খৃস্টানরা ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতো। তাই তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে

আল্লাহ বলছেন

“হে কিতাবধারীগণ, নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে কোন বাড়াবাড়ি করো না।” (নিসা / ১৭১) ,

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর খাঁটি বান্দার পরিচয় দিয়ে বলেছেন

“যারা খরচ করলে না অপচয় করে, না কার্পণ্য করে বরং দু’সীমার মধ্যবর্তী নীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকে।” (ফোরকানঃ ৬৭)

অর্থাৎ খাঁটি বান্দা হতে হলে যেসব গুণ থাকতে হয়  তার অন্যতম হচ্ছে খরচের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। অপচয় করা যাবে না আবার কৃপণতাও করা যাবে না বরং মাঝামাঝি অবস্থানন গ্রহন করতে হবে। শুধু খরচের ব্যাপারেই নয়, সব ব্যাপারেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন ইসলামের অন্যতম শিক্ষা।

মহানবী সা. বলেছেন,

“অযথা কঠোরতা অবলম্বনকারীরা ধ্বংস হয়ে গেছে।” (মুসলিম)

আরেকটি হাদিসে মহানবী সা. বলেছেন,

“আল্লাহর দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি এ দ্বীনকে কঠিন বানাবে তার ওপর তা চেপে বসবে। কাজেই মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করো। (বুখারী)

আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, মহানবী সা. বলেছেন,

“মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো ও সামর্থ অনুযায়ী দ্বীনের উপর আমল করো    –” (বুখারী)

মোট কথা চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি ইসলামে গর্হিত অপরাধ। মধ্যমপন্থাই ইসলামের পথ। ইসলামের পন্থাকে বলা হয়েছে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ। এখানে চরম পন্থার কোন স্থান নেই। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইসলামের প্রথম চরমপ্নথী দল খারেজী  সম্প্রদায়কে সমস্ত মাজহাবই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী বলে আখ্যায়িত করেছে।

জ)  ক্ষতি করা যাবে না আবার ক্ষতিগ্রস’ হওয়াও যাবে না –

মহানবী সা. বলেছেন,

“ক্ষতি স্বীকার করা এবং অন্য কারো ক্ষতি করা এ দুটোই নিষিদ্ধ।” (ইমাম মালিক, আহমদ, ইবনে মাজাহ)

কাজেই কোন আচরণ বা কাজ দ্বারা যেমন কারো কোন ক্ষতি করা যাবে না ঠিক তেমনি নিজেও তিগ্রস’ হওয়া যাবে না। কোন আচরণ বা কাজ এমন হতে হবে যাতে কারো কোন ধরনের ক্ষতি না হয় আবার এ কাজ নিজের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারবে না। যেমন: হত্যা ও আত্মহত্যা উভয়টিই নিষিদ্ধ। তবে সমষ্টির স্বার্থে নিজের ক্ষতি স্বীকার করাটা ইসলাম অনুমোদন করে এমনকি অধিকতর কাম্য মনে করে।
ঝ) সামষ্টিক কল্যাণ ও ব্যষ্টিক কল্যাণ এর মধ্যে সমন্বয়ই কাম্য ঃ  ইসলাম মানুষের কল্যাণ চায়। কোন ব্যক্তির কল্যাণই ইসলাম গুরুত্বহীন মনে করে না। ব্যক্তির ব্যক্তিগত কল্যাণকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি ব্যক্তির অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা কোন সরকারেরও সাধারণভাবে অধিকার নেই। তবে সমষ্টির বৃহত্তর কোন কল্যাণে তা করা যেতে পারে। তবে সেটা করা যাবে বিকল্প কিছু না থাকলে। বস’ত সামষ্টিক কল্যাণ ও ব্যষ্টিক কল্যাণ এর মধ্যে সমন্বয়ই কাম্য। তবে এ দু’টোর মধ্যে সংঘাত তৈরি হলে সামষ্টিক কল্যাণই অগ্রাধিকার পাবে।

ঞ) দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক সব কিছুরই ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে হবে ঃ

মহানবী সা. বলেছেন,

“আল্লাহর শপথ! তোমাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং বেশী তাকওয়া অবলম্বন করি। কিন’ আমি রোজা রাখি আবার খাই, নামাজ পড়ি আবাব ঘুমাই এবং বিয়ে শাদীও করি। (এটাই আমার নিয়ম) যে ব্যক্তি আমার নিয়ম পালন করবে না সে আমার (দলভুক্ত ) নয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

বুখারীর এক বর্ণনায় রয়েছে –

“তোমার উপর তোমার রবের (আল্লাহর) হক  আছে, তোমার উপর তোমার নিজের হক আছে, তোমার উপর তোমার পরিবারের হক আছে। কাজেই প্রত্যেক হকদারের হক আদায় করো।” (বুখারী)

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের উপর মানুষের স্রষ্টার (অর্থাৎ তার আত্মার) হক রয়েছে, তার মানসিক হক রয়েছে, তার দেহের হক রয়েছে। কাজেই ইসলামী নৈতিকতা মানেই প্রতিটি হক  যথাযথভাবে আদায় করা। অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক সবকিছুরই গুরুত্ব দিতে হবে, সবগুলোর বিকাশ সাধন করতে হবে। বস’ত ইসলাম এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। তার নৈতিক দৃষ্টিকোণও তেমনি ভারসাম্যপূর্ণ।

নৈতিকতা গঠনে শিক্ষার ভূমিকা শিক্ষা হচ্ছে নৈতিকতা গঠনের জন্যে সর্বাধিক কার্যকর উপায়। তাই ইসলাম শিক্ষার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। একটি পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাকে অবশ্য করণীয় কর্তব্য বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই একটি জাতিকে যথার্থরূপে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে পারলে তাদের নৈতিকমান উন্নত করা সম্ভব। তবে প্রসঙ্গত একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধু প্রযুক্তিগত শিক্ষার দ্বারা নৈতিকতার উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব কিন’ সত্যিকার সৎ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বরং এর জন্যে নৈতিকশিক্ষা ও মানবিক শিক্ষা প্রয়োজন। আর সত্যিকার নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার যোগান ইসলামের আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব।  মানুষকে ইসলামী মনোভাব সম্পন্ন রূপে গড়ে তুলতে পারলেই যথার্থ নৈতিক মান উন্নয়ন সম্ভব। তাই বলা যায় যে ধর্ম বাদ দিয়ে শুধু পেশাগত শিক্ষার মাধ্যমে আজকের দুনিয়ার নৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব নয়। ইসলামের নৈতিক শিক্ষার যথাযথ প্রসারের মাধ্যমেই সঠিক চরিত্রের মানুষ গড়ে তোলা যেতে পারে। তাই নৈতিকতার উন্নয়নের লক্ষ্যে যথার্থ পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস’াকে ইসলামী আদর্শের আলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস’াকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে তরুণদের মধ্যে দক্ষতার উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিকবোধও জাগ্রত হয়। আজকে দেশের নৈতিক ও চারিত্রিক মান যে পর্যায়ে নেমে গেছে তাত্থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হলে একটি  নৈতিক মান সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস’াই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলাম যে নৈতিকতার মান নির্ধারণ করেছে তা অর্জনের জন্য আমাদেরকে সবিশেষ প্রয়াস চালাতে হবে। এজন্য নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং  দক্ষতা ও উন্নয়নধর্মী  শিক্ষা ব্যবস’া চালু করতে হবে। তাহলেই একটি উন্নত, নৈতিকতাসম্পন্ন, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব।

গ্রন্থকার:
আশরাফুজ্জামান মিনহাজ
গবেষক ও পিএইচডি, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কানাডা।
www.facebook.com/Minhaz

====================================================================

অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ

====================================================================

________________________________________


আপনার ব্লগ দেখতে ক্লিক করুন এখানে

আপনার বয়স সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর পেতে ক্লিক করে সহযোগিতা নিন এখান থেকে


====================================================================
সকল সংবাদপত্রগুলির লিংক
====================================================================
প্রয়োজনীয়, জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু যোগাযোগ নম্বরের লিংক
====================================================================
শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য, পুরষরা উঁকি দিতে চেষ্টা করবেন না . . . ২
====================================================================
অভ্র বা বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইন্টারনেট জগতে অতি সহজে বাংলা লেখার উপায় . . .
====================================================================
যারা অভ্রতে লেখেন তারা ক্লিক করতে পারেন লিংকটিতে
====================================================================
একহাজার . . . একটি টিপস
====================================================================
ঘুরে আসুন ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়ার ডীপ ওয়েব, ডার্ক ওয়েব সাইটগুলো থেকে।
====================================================================
ইংরেজি বিষয় সহ জেনে নিন প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ, মজার কিছু তথ্য . . . ১