মোহাম্মদ আলী বেলাল
———————
 
৩৪তম বিসিএস থেকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রসংগে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে বিদ্যমান পরিস্থিতির একটা তুলনামূলক পর্যালোচনাঃ
ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার পথ সুগম করার ক্ষেত্রে প্রাচীন ঐতিহাসিকগণ মির্জাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করেন। অপরদিকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাকে দায়ীকরেন। অর্থাৎ মির্জাফর আলী খাঁ ইংরেজদের ও ঘসেটি বেগম -এর সাথে গোপনে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন এবং নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এ কথা সিরাজ-উদ-দৌলা পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন তারপরও তিনি তাকে ফাঁসি না দিয়ে বরং পবিত্র কোরান শরীফ শপথের মাধ্যমে তাকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। যুদ্ধক্ষেত্রে তার ৫০০০০ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়ে ইংরেজ বাহিনী বিজয় লাভকরে। সুতারাং নবাবের পরাজয়ের জন্য নবাব নিজেই দায়ী। তাঁর সরলতা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া যে- বিশ্বাসঘাতকরা, সুবিধাভোগিরা, লোভীরা, স্বার্থপররা কখনও তাদের চরিত্র পাল্টাতে পারে না। এক্ষেত্রে আমার নিজস্ব মূল্যায়ণ- এজন্য উভয়েই দায়ী।
মাউশি আমাদেরকে অর্থাৎ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের শাসনের নামে শোষণ ও নির্যাতন করার পথ সুগম করার ক্ষেত্রে ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে পচামালে রূপান্তরের ক্ষেত্রে (অর্থমন্ত্রীর ভাষায়) শিক্ষার গুণগতমান প্রত্যাশিত পর্যায়ে না থাকার ক্ষেত্রে (মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায়) বাসমাশিসের বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শিতা ও সরলতা উভয়ই দায়ী।
আমরা যদি সরকারের সবচেয়ে জন গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটির (মাউশি) সার্বিক কর্মযজ্ঞকে পর্যবেক্ষণ বা গবেষণামূলক দৃষ্টিতে দেখি বা বিশ্লেষণ করি তখন পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাই এ প্রতিষ্ঠানটি তার সার্বিক কর্মকাণ্ডকে দুইটিভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। প্রথমভাগে আছে সরকারি/বেসরকারি কলেজ ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো এবং প্রকল্প থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারি। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে শুধু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলো। আমরা যদি এই দুই ভাগ বা পক্ষের প্রতি তার (মাউশি) আচণের তূলনামূলক আলোচনা করি তাহলে এর ১ম পক্ষের প্রতি মাতাসুলভ ২য় পক্ষের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখতে পাই।

১ম পক্ষের সরকারি কলেজের স্যারদের পদোন্নতি যথাসময়ে হয় আবার কখনও কখনোও অগ্রিম হয় এবং সিলেকশন গ্রেড/ টাইমস্কেলও যথাসময়ে হয়। চাকুরির এই স্বাভাবিক পাওনাগুলো পেতে তাদের কোন রকম বেগ পেতে হয়না। বেসরকারি স্কুল/কলেজের শিক্ষকগণ এক সময় শুধু স্কেলের ৬৫% বেতন পেতেন বর্তমানে তারা ১০০% বেতনের সাথে বাড়ী ভাড়াও পাচ্ছেন। এগুলো তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফল। বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মচারিরা রাজস্ব খাতে এসে এখন মাধ্যমিকের বিভিন্ন রকম কর্মকর্তা হয়েছেন এবং হতে যাচ্ছেন।
পক্ষান্তরে-
২য় পক্ষের অর্থাৎ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর স্যার দের অনুরূপ পাওনাগুলো পেতে অনেক বেগ পেতে হয় আবার বেশীরভাগ সময় না পেয়েও অবসরে যেতে হয়। যেমনঃ নিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতির জন্য অনেকগুলো পদ শুণ্য থাকার পরেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত প্রায় ৩০০০ শিক্ষকের , সিলেকশনগ্রেড ও টাইমস্কেল ডিউ হয়ে রয়েছে কিন্তু তা-ও দেওয়া হচ্ছে না।
এখানেই মাঊশি প্রশাসকের নামে আমাদেরকে ইংরেজদের মত নির্যাতন করছে, করছে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। এক্ষেত্রে বাসমাশিসের বিশ্বাসঘাতকতায় তারা আমাদের বঞ্চনার দায়ভার আমাদের উপরই চাপিয়ে দিয়ে তারা থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে- একেবারেই নির্দোষ হয়ে। আর এ সবকিছুই তারা করতে পারছে আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শিতা, সরলতা এবং আমাদের সব কিছু মেনে নেওয়ার মানসিকতার কারণে।
প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে ?
উত্তর পেতে হলে আপনাকে যে যে বিষয় গুলোর প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবেঃ
সরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ্ হয় পদোন্নতির মাধ্যমে অর্থাৎ এসোসিয়েট প্রফেসরকে ও প্রফেসরকে যথাক্রমে উক্ত পদে পদায়ন করা হয়। এখানে সরাসরি উক্ত পদগুলোতে নিয়োগের কোন সুযোগ নাই। সুতারাং এখানে কোন বিভাজন নেই।
 
পক্ষান্তরে,
সরকারি স্কুলগুলোতে সহকারি প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক উভয় পদে সরাসরি নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। অপরদিকে পদোন্নতির মাধ্যমে উক্ত পদগুলো পুরণ করার বিধান আছে। ফলে যারা সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হন তারা নিজেদেরকে ব্রাক্ষ্মণ ভাবেন আর যারা পদোন্নতির মাধ্যমে যান তারা নিজেরদেরকে সিপাই থেকে দারগা মানে খুবই অভিজ্ঞ ভাবেন। এই দুই দলের মধ্যে ইগো প্রবলেম তৈরী হয়। এখানে ব্রিটিশদের ডিভাইড এন্ড রুলস থিউরির স্বার্থক প্রয়োগ দেখতে পাবেন। কারণ, তারা এ ব্যবস্থা উদ্দ্যেশপ্রণোদিতভাবেই রেখেছেন। তাদের খেলা এখানেই শেষ না। পদোন্নতির জন্য আবার দুই ধরনের বিধি, প্রথমতঃ বি.এড. থেকে সিনিয়রিটি, দ্বিতীয়তঃ যোগদান থেকে সিনিয়রিটি। এজায়গায় তারা ১০০% সফল। প্রজ্ঞাপন দুইটি এমনভাবে করেছেন যাতে দুই দলই যার যার অবস্থান থেকে সঠিক। যারজন্য কেউ কাউকে ছাড় দিবে না, যা ।নিষ্পত্তির জন্য কোর্ট অনিবার্য, এটা তারা নিশ্চিত হয়েই এ ব্যবস্থা রেখেছেন। ফলাফল পদোন্নতি বন্ধ। বর্তমান অবস্থাটা হয়েছেও তাই। এতো গেল প্রধানদের ক্ষেত্রে তাদের কুটচাল। সহকারি শিক্ষকদের ব্যাপারতো আরও ভয়াবহ- ভয়ংকর !!!
 
সরকারি কলেজে যেসকল বিষয়ের শিক্ষক লেকচারার হিসেবে প্রবেশ করে তাদের মধ্যে গ্রেড বা মর্যাদার দিক থেকে কোন ভিন্নতা নেই- সবাই সমান। কিন্ত সরকারি উচ্চ বিদ্যায় গুলোতে ঐ একই উদ্দ্যেশে নানা রকমের নানা কিছিমের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা রেখেছেন। এখানে বাংলা ও কৃষি শিক্ষকের মধ্যে ভিন্নতা আছে, আবার গণিত ও ধর্মের মধ্যে অনুরূপ পার্থক্য আছে। সহকারি শিক্ষকদের মধ্যে ইগো এবং দলাদলি সবই আছে। এভাবেই মাউশি আমাদেরকে ইংরেজদের মত নির্যাতন করে- করছে। আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরী করে রাখে। যদি তাদেরকে প্রশ্ন করা হয় স্যার সরকারি কলেজের সবকিছুই যথাসময়ে হয় আমাদেরটা হয়না কেন ? উত্তরে তারা বলেন- আমরা কি করবো তোমারাইতো আদালতে গিয়ে সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছ। আমাদের সহজ সরলমনা শিক্ষকগণ বিশ্বাস করে ফিরে চলে আসেন ।
 
আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও ইফতার পার্টিতে শিক্ষকদেরকে রিট তোলার জন্য বলেন। তিনি গভীরে যেতে পারলেন না। প্রশ্ন করতে পারলেন না কেন তারা রিট করেছে তাদের আদালতে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে কারা ? কারা এর জন্য দায়ী ?
এমন পরিস্থিতিতে আবার সুস্পষ্ট নিয়োগ বিধি ছাড়া টিচার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয় সেক্ষেত্রে নিয়োগের পরে নতুন নিয়োগ বিধি তৈরী করে আমাদের মধ্যে নতুনদের মধ্যে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা আছে কিনা ? এছাড়া আমি যতটুকু জানি নতুন নিয়োগ বিধিতে সিনিয়র শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে পদটিকে ৯ম গ্রেডের (১ম শ্রেণি) গেজেটেড কর্মকর্তা করার কথা। যদি সরকার এভাবে নিয়োগ দিয়ে দেয় তাহলে অবশ্যই শিক্ষক স্বল্পতার চাপ সরকারের উপর থেকে কমে যাবে, সেক্ষেত্রে নিয়োগ বিধি তৈরীতে কোনরূপ শিথিলতা আসবে কি না ? আসলে আমাদের কী ক্ষতির সম্ভাবনা আছে ? আমি একটা ক্ষতির সম্ভাবনা দেখি, আর তা হলো সরকার যে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে স্কুল সরকারি করার ঘোষণা দিয়েছেন তা নিয়োগ বিধির পূর্বে হয়ে গেলে সেই স্কুলগুলোর অনেক স্যার আমাদের সিনিয়র হয়ে যাবেন। কারণ নিয়োগ বিধিছাড়া তারাও সহকারি শিক্ষক আমরাও সহকারি শিক্ষক আর নিয়োগ বিধি কমপ্লিট করলে আমরা সবাই সিনিয়র শিক্ষক হয়ে যাব। আত্মীকরণে সবাই সহকারি শিক্ষক হিসাবে থাকবে ঠিক কলেজের মত।
আমি সবাইকে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাকরার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
 
 
(চলবে)

লেখকঃ

মোহাম্মদ আলী বেলাল
যুগ্ম আহবায়ক
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি
(বাসমাসশিস)
ফোনঃ ০১৭৫৭ ৮২০ ৬৪৮
ই-মেইলঃ  malibelal175@gmail.com