অপ্রকাশিত অনুভব — ৩

আপা,

অনেক দিন ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা কিছু কথা আছে, যেগুলো আজ তোমার কাছে না বললে আর পারছি না। জানি, বলা উচিত না। জানি, তোমার নিজের একটা পৃথিবী আছে- সুখ, দুঃখ, ব্যস্ততা আর দায়িত্বের হাজারো হিসেব। তবু কী জানো, আজ এতদিন পর এই না বলা কথাগুলো বুকের ভেতর আর ধরে রাখতে পারলাম না। এই চিঠিটা লিখছি তোমার জন্য, আবার নিজের জন্যও। বুকের ভেতরের কান্নাটা একটু হালকা করার জন্য।

জীবনে অনেক কিছু শিখেছি।
“মায়া ত্যাগ করুন”

একটা সিনেমার এই লাইনটা প্রথম শুনেই মনে মনে বলেছিলাম- তাই তো! এতদিন ধরে এই মায়া, এই আশা ধরে রেখে কী লাভ? শতবার ভেবেছি এই মায়া ছেড়ে দেবো। বলেছি নিজেকে- যে ভালোবাসা নিজের নয়, তার জন্য আর মায়া নয়। তবু পারিনি।

ভিডিও

“অতিরিক্ত আশা ছেড়ে দিন”

এই মায়াটা তোমার জন্য এতটাই গভীর হয়ে গেছে, জানো আপা, মাঝে মাঝে মনে হয় এই মায়ার শিকড়টা বুঝি আমার আত্মার ভেতর কোথাও গেঁথে আছে। মুছে ফেলতে গেলে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তোমার হাসিমুখ, তোমার চোখের ভেতরকার সেই নিঃশব্দ ভাষা- কিছুই ভুলতে পারিনি।

আজ ভাবছি, হয়তো অতিরিক্ত আশা করাটাই আমার ভুল ছিল। যে মানুষটাকে না বলা কথার ভিড়ে প্রতিদিন খুঁজে ফিরি, তার কাছে থেকে কিছু চাওয়া মানেই নিজের হৃদয়কেই প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত করা। কখনো কখনো কিছু মানুষ থাকে, যাদের শুধু ভালোবেসে যেতে হয়। কোনো আশা ছাড়াই। কোনো দাবি ছাড়াই। তাই ঠিক করলাম… অতিরিক্ত আশা ছেড়ে দেব। কারণ ভালোবাসা মানে যে সবসময় পাওয়া নয়, বরং নীরবে কারো মঙ্গলের প্রার্থনা করে যাওয়া।

এক সময় শিখেছিলাম টাকা ইনকাম করতে।
“টাকা ইনকাম করতে শিখুন।”

হ্যাঁ, শিখেছি। সংসার চলে, মানুষ হাসে। বাহিরটা রঙিন লাগে। তবু জানো? টাকার হিসেবের বাইরে তুমি ছিলে আমার জীবনের এমন একটা হিসেব, যার হিসেব কোনো হিসেবের খাতায় লেখা যায় না। কত শত রাতে টাকার অঙ্কের বাইরেও তোমার নাম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক সময় নিজের আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেছি- কেমন করে সম্ভব, একটা মানুষকে এমন ভালোবাসা?

“নিজেকে সময় দিন।”

এই কথাটাও শুনেছি। ভেবেছি- এবার নিজের জন্য বাঁচব। তোমাকে ভুলে নতুন করে সময় কাটাবো। কিন্তু জানো? বিকেলের আকাশের রঙ দেখে হঠাৎ তোমার সেই মিষ্টি হাসিটা চোখে ভেসে ওঠে। তোমার বলা ছোট্ট কথাগুলো মনে পড়ে। মনে হয়, তুমিই তো আমার সময় ছিলে। এখন সেই সময়টা শুধু স্মৃতি।

তুমি বলেছিলে-
“চিন্তা করা বাদ দিয়ে হাসিখুশি থাকুন।”

হাসি শিখেছি আপা। মানুষের সামনে সব সময় এক গাল হাসি রেখেছি। বন্ধুদের আড্ডায়, স্কুলের বাচ্চাদের সাথে, আত্মীয়-স্বজনের সামনে, হাসতেই শিখেছি। কিন্তু গভীর রাতে, যখন জানালার পাশে বসে বাতাসের শব্দ শুনি- তখন তোমার কথা ভেবে একা কান্না করি। জানো, কেউ বোঝে না এই হাসির আড়ালে কতটা ভাঙা বুক লুকিয়ে আছে।

অনেকে বলে —
“মিথ্যা ভালোবাসার পিছনে ছুটবেন না।”

জানি, তুমিও বললে হয়তো একথাই বলতে। কিন্তু জানো আপা, এই ভালোবাসাটা কখনো মিথ্যা ছিল না। জানতাম, তুমি কোনোদিন আমার হবে না। তবু এই অনুভবটুকু বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছি। কারণ এই অনুভব ছিল একমাত্র আমার। তোমার অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলা ছিলো আমার একান্ত এক অপরাধ।

কতদিন তোমার হালকা একটা হাসি দেখেই আমার দিন ভালো কেটেছে। তোমার একটা কথায় দিনভর মন ভালো থেকেছে। তুমি জানো না, কত শত রাত তোমার কথা ভেবে কাটিয়েছি। শুধু ভেবেছি- যদি কখনো জানতে পারতে, কেউ তোমাকে এমন নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে।

আজও শিখছি —
“যা কিছুই হোক না কেনো, নিজেকে বলতে শিখুন, কিছুই হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক।”

জানি আপা, সব কিছু ঠিক নেই। আমার ভেতর ভাঙা, পোড়া একটা বুক লুকিয়ে আছে। তুমি সেটা কোনোদিন দেখতে পারবে না। তবু মানুষের ভিড়ে হেসে বেঁচে থাকি। কারণ জানি, এই অনুভব কাউকে বলা যায় না। কারো কাঁধে মাথা রেখে কান্না করার জায়গাও নেই।

অনেক সময় ভাবি- তুমি যদি পাশে থাকতে, হয়তো এমন হতো না। আবার ভাবি- তুমিই তো একদিন শিখিয়েছিলে, ভালোবাসা মানে পাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে যার জন্য ভালোবাসা, সে যেন ভালো থাকে। তাই তো আজও তোমার সুখের জন্য নিঃশব্দে দো’য়া করি। কখনও বিরক্ত হইনি, কখনও অভিমান করিনি। কারণ তুমি আমার কাছে ভালোবাসা নয়- শ্রদ্ধা, সম্মান।

তোমার জানা উচিত ছিল —
এই শহরে হাজার মানুষের ভিড়ে,
তোমার নাম ধরে কাঁদে একটা বুক।
ভোররাতে উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
একটা মানুষ, যে নিজের সমস্ত সুখ ভুলে তোমার হাসিমুখের অপেক্ষা করে।
সে আজও বেঁচে আছে, শুধু তোমার সুখের আশায়।

তুমি হয়তো কোনোদিনও এই চিঠিটা পড়বে না। আর পড়লেও হয়তো শুধু হেসে বলবে- পাগল !
কিন্তু জানো আপা, এই পাগলটাও একদিন এই শহরে তোমার সুখের জন্য নিঃশব্দে দোয়া করত- এখনও করে।
ভালো থেকো আপা। সব সময়।

তোমার হাসিমুখ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সোনালি আলো হয়ে তোমার জীবনটা ভরিয়ে রাখে। আর কোনো একদিন যদি একা হয়ে পড়ো, এই বিশাল পৃথিবীতে কাউকে খুঁজে না পাও- তখন এই চিঠিটার কথা মনে করো।

একটা মানুষ ছিল, যে তোমাকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভালোবেসেছিল। কোনো দাবি ছাড়াই। শুধু চেয়েছিল- তুমি ভালো থাকো।

ভালো থেকো আপা।
অপ্রকাশিত . . .