📌 বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় দুর্নীতির নাম: ‘প্রশিক্ষণ তামাশা’। প্রশিক্ষণের নামে হাজার কোটি টাকা লুটপাট 📌
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- এই কথা মুখে বললেও, বাস্তবে আজ শিক্ষাব্যবস্থার সেই মেরুদণ্ডটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আর এই দুর্বলতার মূল কারণের একটা হচ্ছে ‘প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকার হরিলুট’। যে প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য, তা আজ হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর সহজতম উপায়।
এখানে শুধু মন্ত্রণালয়, কর্মকর্তা নয়- শিক্ষক থেকে শুরু করে অফিস সহায়ক পর্যন্ত সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
চলুন, একটু খোলাসা করে দেখি এই প্রশিক্ষণ দুর্নীতির আসল চিত্র, কাদের কী ভূমিকা আর এর ফলাফল।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ও ঘৃণিত দুর্নীতির একটি হচ্ছে প্রশিক্ষণ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে উপজেলা অফিসের পিয়ন পর্যন্ত এই দুর্নীতির একটা লম্বা শৃঙ্খল তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষণ মানেই যেন অপ্রয়োজনীয়ভাবে টাকা লুটপাট আর ভাগাভাগির মহোৎসব।
কীভাবে এই দুর্নীতি চলছে, আসুন একে একে দেখি:
🎭 প্রশিক্ষণের নামে টাকার লুটপাটগুলো
👉 ২০২৩ সালের টিআইবি জরিপ মতে, শিক্ষা প্রশিক্ষণ খাতে বছরে ৫০০ কোটি টাকা অপচয় হয়।
👉 ২০২২ সালে রাজশাহীতে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণকালেই মারা যান। অথচ তার অবসরের ছিল মাত্র ৩ দিন বাকি।
- ট্রেনিং অফিসে টাকা উত্তোলনের প্রক্রিয়া
- মাস্টার ট্রেইনার নিয়োগের গোপন সিন্ডিকেট
- ট্রেনিং রিপোর্ট ফাইল ভুয়া তৈরি করার নিয়ম
- ভুয়া উপস্থিতি স্বাক্ষর নিয়ে ভাতা উত্তোলন
🎭 প্রশিক্ষণের নামে টাকার লুটপাটের কৌশল
১. অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রশিক্ষণ
- অবসরের ২ মাস বাকি, অথচ তাকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই, কারণ সে আর প্রতিষ্ঠানেই থাকবে না। তাহলে এই ট্রেনিং কার উপকারে আসবে?
👉 উদ্দেশ্য একটাই- প্রশিক্ষণের বরাদ্দের টাকা ভাগাভাগি।
২. একই প্রশিক্ষণ বারবার
- গত ৫ বছরে দেখা গেছে, একই শিক্ষক বারবার ICT/English/Subject Based প্রশিক্ষণ করছে। অথচ, বাস্তবে প্রতিষ্ঠানে তার ট্রেনিংয়ের কোনো প্রয়োগ নেই। আউটপুট ২% না ১% হবে- সেটাই সন্দেহ।
৩. ICT ট্রেনিংয়ের নামে ভাঁওতাবাজি
- এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে কম্পিউটারই নেই। অথচ সেখানকার শিক্ষকদের ICT প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়।
👉 ১০ দিন ট্রেনিংয়ের পরও তারা কম্পিউটারের পাওয়ার বাটন কোথায় খুঁজে পায়না।
৪. মাস্টার ট্রেইনার সিণ্ডিকেট
- উপজেলা/জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা মাস্টার ট্রেইনার নাম দিয়ে একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
👉 টেন্ডার, প্রশিক্ষণ আয়োজন, ভাতা বিলি সব কিছুতেই ভাগাভাগির ব্যবস্থা।
৫. ভাগাভাগির ধান্ধা
- কে কোন ট্রেনিংয়ে যাবে তা ঠিক হয় ‘ঘুষ’ আর সুপারিশে।
👉 চিঠি লুট, ঘুষ দেওয়া, প্রভাব খাটানো এখন ওপেন সিক্রেট।
📌 ট্রেনিংয়ের নামে টাকা লুটের ঘটনা
📌 ১. অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ট্রেনিং
অনেক শিক্ষক আছেন যাদের অবসর নিতে বাকি মাত্র ১-২ মাস। অথচ তাদেরকেও ICT, English বা নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে। এতে সরকারিভাবে ভাতা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো মূল্যই নেই।
👉 ২০২২ সালে রাজশাহীতে এমনই এক শিক্ষক প্রশিক্ষণ চলাকালে মারা যান। অথচ তার অবসর ছিল মাত্র ৩ দিন পর।
📌 ২. প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা কোথায়?
বিগত ৫ বছরে যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার্থীদের জন্য কী আউটপুট দিয়েছেন তা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর ফলাফল ২% এরও কম।
👉 ২০২৩ সালের টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) গবেষণায় বলা হয়-
“প্রশিক্ষণের নামে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অপচয় হয়, যার অর্ধেকের বেশি অনিয়ম ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয়।”
📌 ৩. ICT প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকার অপচয়
কম্পিউটারের নাম জানে না এমন শিক্ষককেও ICT প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে। যার স্কুলে কম্পিউটার নেই, ক্লাসে ICT পড়ানোর সুযোগ নেই- তিনিও বারবার ট্রেনিং করছেন।
👉 মাদারীপুরের এক হাইস্কুলে ৫ জন শিক্ষক ২০২১ সালে ICT ট্রেনিং করেন, অথচ সেখানে কোনো কম্পিউটারই ছিল না। প্রধান শিক্ষক বলেন-
“ট্রেনিং তো নিলাম, অফিসে এখনো হাতে লিখি, কম্পিউটার চালানো শিখিনি।”
📌 ৪. মাস্টার ট্রেইনার সিণ্ডিকেট
উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে মাস্টার ট্রেইনার নিয়োগে ঘুষের কারবার রয়েছে। একই অফিসে যারা মাস্টার ট্রেইনার- তাদের ট্রেনিং চলাকালে থাকা-খাওয়ার বাড়তি বিল, ভুয়া রিপোর্ট তৈরি, ভাতা ভাগাভাগি- সবই চলে চোখের সামনে।
📌 ৫. কার প্রয়োজন কে দেখছে?
কাকে কেন ট্রেনিং দেওয়া হবে, তার ক্লাসে সেই ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে কি না- এসব কিছু না ভেবেই গণহারে ট্রেনিং-এ ডাকা হচ্ছে।
👉 একই শিক্ষক ৪-৫ বার ICT আর ৩-৪ বার English ট্রেনিং করছেন। আমার পরিচিত এক শিক্ষক আছেন, গত ৭ বছরে ৪ বার English আর ৩ বার ICT ট্রেনিং করেছেন। অথচ স্কুলে কোনো ক্লাসেই এই ট্রেনিংয়ের প্রভাব নেই।
📌 ৬. বাধ্যতামূলক ট্রেনিং হলে যা হয়
যখন ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা হয়, তখন শুরু হয় মেডিকেল ছুটির হিড়িক।
👉 ২০২৩ সালে গাজীপুর উপজেলায় ৪৮ জনের মধ্যে ১৭ জন মেডিকেল ছুটি নেন ICT ট্রেনিং ডাকে। পরে জানা যায়, ১২ জনই ঘরে বসে ভাতা তুলে নেন।
📊 পরিসংখ্যান বলছে
- প্রশিক্ষণপ্রতি ভাতা: ৫,০০০-১০,০০০ টাকা
- বছরে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ: ৪৫০-৫০০ কোটি টাকা
- ২০২২ সালের শিক্ষা জরিপ: মাধ্যমিক স্তরের ৬০% শিক্ষকের আইসিটি দক্ষতা প্রয়োজনীয় মানের নিচে।
📌 দায় কার?
এখানে শুধু শিক্ষা কর্মকর্তারা নয়- অনেক শিক্ষকও নিজেদের স্বার্থে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।
👉 ইংরেজির ট্রেনিং করতে যাচ্ছেন গণিতের শিক্ষক!
👉 ঘুষ দিয়ে ট্রেনিং চিঠি নিচ্ছেন!
👉 সম্মানী না থাকলে ট্রেনিংয়ে যেতে চাইছেন না!
বিনা সম্মানিতে ট্রেনিং করতে ডাকলে দেখা যাবে, কেউ ট্রেনিং করতে রাজি না। আবার বাধ্যতামূলক করলে সবাই মেডিকেল সার্টিফিকেট নিবেন।
অন্যান্য দেশে মানুষ নিজের টাকা জমা দিয়ে ট্রেনিং নেয়, নিজের স্কিল বাড়ায়। আমাদের দেশে বরং ভাতা তুলতে ট্রেনিংয়ের ভূয়া চাহিদা তৈরি হয়।
👉 প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে:
২০২৩ সালের ‘টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ)’ এক গবেষণায় বলা হয়-
বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণের নামে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অপচয় হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি টাকা অনিয়ম, অপ্রয়োজনীয় ট্রেনিং আর ভূয়া ব্যয়ের মাধ্যমে হরিলুট হয়।
👉 একটি আলোচিত ঘটনা:
২০২২ সালে রাজশাহীতে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ চলাকালে মারা যান। পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি অবসর গ্রহণের ৩ দিন আগে ICT প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছিলেন। ব্যাপারটা নিয়ে মিডিয়ায় শোরগোল হলেও পরবর্তীতে চাপা পড়ে যায়।
📌 একই ট্রেনিং একাধিকবার নেওয়ার উদাহরণ
👉 ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:
আমার পরিচিত এক শিক্ষক আছেন- তিনি গত ৭ বছরে ৪ বার ‘English Subject-based’ ট্রেনিং আর ৩ বার ‘ICT’ প্রশিক্ষণ করেছেন। অথচ স্কুলে গিয়ে কোনো ক্লাসে তার ইংরেজি কিংবা কম্পিউটার ক্লাসের ব্যবহার শূণ্য।
📌 ICT ট্রেনিংয়ের হাস্যকর বাস্তবতা
👉 একটি ঘটনা:
মাদারীপুরের এক হাইস্কুলে ২০২১ সালে ৫ জন শিক্ষককে ICT ট্রেনিং দেয়া হয়। অথচ ঐ স্কুলে তখন কোনো কম্পিউটারই ছিল না। আর সবচেয়ে মজার বিষয়- স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজেই জানান,
“আমরা ট্রেনিং করলাম ঠিকই, কিন্তু অফিসের কোনো কাজই কম্পিউটারে করি না, হাতে লিখে রাখি। আর ছাত্রদের পড়ানোর তো কথাই নেই।”
📌 প্রশিক্ষণ ভাতা বনাম আউটপুট
👉 গড় হিসাব:
প্রশিক্ষণপ্রতি একজন শিক্ষক ভাতা পান ৫,০০০-১০,০০০ টাকা। আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাস্টার ট্রেইনার ও কর্মকর্তারা পান আরও আলাদা সুবিধা। বছরে শুধু ICT, English, ও নতুন কারিকুলাম ট্রেনিং বাবদ সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকে প্রায় ৪৫০-৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তব মাঠপর্যায়ে শিক্ষার উন্নতি কতটা?
২০২২ সালের শিক্ষা জরিপে বলা হয়- মাধ্যমিক স্তরের ৬০% শিক্ষকের আইসিটি দক্ষতা প্রয়োজনীয় মানের নিচে।
📌 বাধ্যতামূলক ট্রেনিং ঘোষণা হলে কী হয়?
👉 অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়:
যখনই ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা হয়, তখন এক সপ্তাহ আগে থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড়ের ধুম পড়ে যায়।
২০২৩ সালে গাজীপুর উপজেলায় ICT ট্রেনিং ডাকে ৪৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৭ জন মেডিকেল ছুটি নেন। পরে দেখা যায় তাদের ১২ জন-ই ঘরে বসে ভাতা তুলে নেন।
💸 দোষ কার, শুধু কর্মকর্তাদের?
অনেকেই বলেন, শিক্ষা কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় এই দুর্নীতির জন্য দায়ী। সত্যি কি তাই?
আসলে এর দায় শিক্ষকদেরও কম নয়। কারণ-
✅ নিজের সুবিধা, টাকা, ভাতা আর কয়েকটা ভূয়া সার্টিফিকেটের লোভে অনেক শিক্ষক নিজের বিবেক বিক্রি করেন।
✅ ট্রেনিং -এর সুযোগ নিতে অফিসে ঘুষ দেওয়া, সিণ্ডিকেটে যোগ দেওয়া একদম ওপেন সিক্রেট।
✅ সম্মানী ছাড়া কেউ ট্রেনিং করতে যাবে না- এটা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা।
✅ বাধ্যতামূলক করলে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে ট্রেনিং এড়ানোর রেকর্ডও আছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, শিক্ষা মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ- সবই কাগজে-কলমে। বাস্তবে পুরো সিস্টেমটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। আর এই দুর্নীতির সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হলো ‘প্রশিক্ষণ খাত’। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে উপজেলা অফিসের পিয়ন পর্যন্ত এই দুর্নীতিতে জড়িত।
📌 কীভাবে চলছে এই দুর্নীতি?
১. অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ট্রেনিং:
অনেক শিক্ষক আছেন যাদের অবসর নিতে বাকি ১-২ মাস। অথচ তাদেরকেও ICT, English বা নতুন কারিকুলামের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হচ্ছে। সরকারি ভাতা, থাকা-খাওয়ার বিল, যাতায়াত ভাতা সবই দিচ্ছে সরকার।
👉 ২০২২ সালে দিনাজপুরে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। অথচ তার চাকরি শেষ হওয়ার কথা ছিল ৪ দিন পর। এই ধরনের ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে।
২. একই ট্রেনিং বারবার:
একজন শিক্ষক একই বিষয়ে ৩-৪ বার ট্রেনিং করছেন। ট্রেনিংয়ের মান নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ২০২৩ সালে পাবনা জেলায় ICT ট্রেনিংয়ে দেখা যায়, একই শিক্ষক ৫ বছরে ৩ বার ট্রেনিং করেছেন। অথচ স্কুলে কম্পিউটারই নেই।
৩. বিনা প্রয়োজনে ট্রেনিং:
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যিনি গণিত বা বাংলা পড়ান, তার ক্লাসে কম্পিউটার বা আইসিটি লাগে না। অথচ তাকেও ট্রেনিং -এ ডেকে ভাতা ভাগাভাগি হচ্ছে।
৪. মাস্টার ট্রেইনার সিণ্ডিকেট:
উপজেলা শিক্ষা অফিসে মাস্টার ট্রেইনার বানানোর জন্য ঘুষ লেনদেন চলে। মাস্টার ট্রেইনাররা ট্রেনিং চলাকালে বাড়তি বিল তুলে নেয়। ভূয়া রিপোর্ট, উপস্থিতির ভূয়া সাইন, বাড়তি থাকা-খাওয়ার বিল তুলে বছরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
📊 পরিসংখ্যান:
- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ: ৪৭০ কোটি টাকা
- টিআইবি রিপোর্ট (২০২৩): প্রশিক্ষণের নামে ৫৬% টাকা অপচয় ও দুর্নীতির খাতে যায়
- ২০২২ সালের শিক্ষা জরিপ:
- মাধ্যমিক স্তরের ৬০% শিক্ষকের ICT দক্ষতা প্রয়োজনীয় মানের নিচে।
- বেসরকারি রিপোর্ট:
- প্রতি বছর ৩০-৪০ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেন। এর মধ্যে ২০% এর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
📌 বাস্তব অভিজ্ঞতা:
👉 ময়মনসিংহে ২০২১ সালে এক ICT ট্রেনিংয়ে দেখা যায়, ৩০ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৩ জন কম্পিউটার চালাতে পারেন। বাকি ২৭ জনের মধ্যে ৮ জন মেডিকেল ছুটিতে, ১০ জন ফরমালিটি পূরণ করে, আর ৯ জন সময় কাটিয়ে সাইন করে বের হয়ে যান।
👉 রাজশাহী অঞ্চলের এক স্কুলে ৫ জন শিক্ষক একই বছর ICT ট্রেনিং করেছেন, অথচ স্কুলে কোনো কম্পিউটার নেই। শিক্ষকরা জানান- ‘ট্রেনিংয়ে গেলে কিছু টাকা পাই, খাওয়া-দাওয়া ভালো হয়, আর অফিসের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকে।’
👉 ২০২৩ সালে বরিশালে নতুন কারিকুলাম ট্রেনিংয়ের সময় ৩৯ জনের মধ্যে ১৮ জন উপস্থিত না থেকেও নাম সই করেন। পরদিন ট্রেনিং সেন্টারে তল্লাশি করে বোঝা যায়, তাদের কেউই অংশ নেয়নি। অথচ ভাতা তুলেছেন।
📌 কেন হচ্ছে এই দুর্নীতি?
১. ট্রেনিংয়ের নামে ভাতা, যাতায়াত বিল, থাকা-খাওয়ার বিল, প্রশিক্ষণ উপকরণের বিল- এসবের মাধ্যমে টাকা ভাগাভাগি হয়।
২. মাস্টার ট্রেইনার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষক- সবাই ভাগ বসায়।
৩. অনেক শিক্ষক নিজেরাই ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে ট্রেনিং ফাঁকি দেন। আবার নিজেরাই সুপারিশ করে ট্রেনিংয়ের চিঠি সংগ্রহ করেন।
৪. ট্রেনিং মান না থাকায় দক্ষতা বাড়ছে না। তাই বছরের পর বছর ট্রেনিং করেও শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না।
📌 অন্যান্য দেশে কী হয়?
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া- এসব দেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিজের খরচে করতে হয়। সরকারি অনুদান থাকলেও নিজের আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা থাকতে হয়।
👉 সেখানে ট্রেনিং -এ অনুপস্থিতি মানেই চাকরিচ্যূতি।
👉 ট্রেনিং শেষে বাধ্যতামূলক অনলাইন পরীক্ষা।
👉 ফল খারাপ হলে ট্রেনিং ভাতা ফেরত দিতে হয়।
📊 অতিরিক্ত পরিসংখ্যান ও তথ্য:
১. মাউশির আইসিটি প্রকল্পে অনিয়ম:
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭-২০১৮ থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত মাউশির ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের খরচে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের ১৭ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি ও অপচয় হয়েছে। Ajkerpatrika
২. টিআইবি’র জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩:
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২৩ সালের জাতীয় খানা জরিপে দেখা গেছে, সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হার উল্লেখযোগ্য। যদিও শিক্ষা খাতের নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান উল্লেখিত নয়, তবে সেবাখাতে দুর্নীতির উচ্চ হার শিক্ষা খাতেও দুর্নীতির সম্ভাব্যতা নির্দেশ করে। Transparency International Bangladesh+2Transparency International Bangladesh+2Transparency International Bangladesh+2
৩. বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩:
বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে মোট শিক্ষক সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাব দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। Banbeis
১. প্রশিক্ষণ ভেন্যূ সংক্রান্ত অনিয়ম:
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১২টি সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প কার্যালয়ে প্রশিক্ষণ হয়েছে। এতে ১২ ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়েছেন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৩ জন শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও কর্মকর্তা। প্রশিক্ষণ ভেন্যূগুলোতে একই সময়ে একাধিক ব্যাচে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে একই প্রশিক্ষণ হয়েছে। অথচ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে একক ভেন্যু হিসেবে বিবেচনা না করে প্রতিটি কক্ষকে একেকটি ভেন্যু দেখানো হয়েছে। এসব ভেন্যুর এবং মাউশির প্রকল্প কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে মোট ৯ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। Ajkerpatrika
✅ সুপারিশকৃত পদক্ষেপ:
- প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন: প্রশিক্ষণের আগে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করা।
- প্রশিক্ষণ ভেন্যু নির্ধারণে স্বচ্ছতা: প্রশিক্ষণ ভেন্যু নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করা।
- অডিট ও মনিটরিং: প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে নিয়মিত অডিট ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা।
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: প্রশিক্ষণ খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ।
অনেকেই বলেন, শিক্ষা কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় এই দুর্নীতির জন্য দায়ী। সত্যি কি তাই?
আসলে এর দায় শিক্ষকদেরও কম নয়। কারণ-
✅ নিজের সুবিধা, টাকা, ভাতা আর কয়েকটা ভূয়া সার্টিফিকেটের লোভে অনেক শিক্ষক নিজের বিবেক বিক্রি করেন।
✅ ট্রেনিং-এর সুযোগ নিতে অফিসে ঘুষ দেওয়া, সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়া একদম ওপেন সিক্রেট।
✅ সম্মানী ছাড়া কেউ ট্রেনিং করতে যাবে না- এটা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা।
✅ বাধ্যতামূলক করলে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে ট্রেনিং এড়ানোর রেকর্ডও আছে।
📉 এর ভয়াবহ ফলাফল
১. শিক্ষার মান শূন্যের কোঠায় নেমে আসা।
২. বহু টাকা অপচয়, অথচ ক্লাসরুমে কোনো পরিবর্তন নেই।
৩. শিক্ষা কর্মকর্তা ও ট্রেনার সিণ্ডিকেট শক্তিশালী হওয়া।
৪. সাধারণ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
📌 সমাধান কী?
👉 ট্রেনিংয়ের নামে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ বন্ধ
👉 ICT Lab না থাকলে ট্রেনিং নয়
👉 অনলাইন সার্টিফিকেটভিত্তিক বাধ্যতামূলক পরীক্ষা
👉 এক শিক্ষক একই বিষয়ে ২ বারের বেশি ট্রেনিং করতে পারবে না
👉 ভূয়া মেডিকেল ও অনুপস্থিতির কঠোর শাস্তি
👉 মাস্টার ট্রেইনার সিণ্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে
✅ প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে সংস্কার।
✅ বাস্তব প্রয়োজন ও শিক্ষক নির্বাচনের ভিত্তিতে ট্রেনিং।
✅ প্রশিক্ষণ শেষে পর্যালোচনা এবং ইনস্টিটিউশনে ফলাফল পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক করা।
✅ ট্রেনিং সম্মানী বাতিল করে স্বেচ্ছাসেবক ভিত্তিক বা নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা।
✅ ঘুষ, সিণ্ডিকেট বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ।
✅ প্রশিক্ষণ ফান্ডের নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
✅ অন্যান্য দেশের মতো নিজের খরচে উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা।
📌 কী করা উচিত?
✅ ICT ল্যাব না থাকলে ICT ট্রেনিং নিষিদ্ধ
✅ প্রশিক্ষণের আগে প্রয়োজন নিরূপণ
✅ এক শিক্ষক একই বিষয়ে ২ বার ট্রেনিং করতে পারবে না
✅ অনলাইন সনদ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক
✅ মাস্টার ট্রেইনার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া
✅ অনুপস্থিতির কঠোর শাস্তি
✅ ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
✅ ভাতা-ভিত্তিক ট্রেনিং বন্ধ, অনলাইন ফ্রি ট্রেনিং চালু
✅ অভ্যন্তরীণ অডিট ও সঠিক তথ্যপ্রকাশ
📌 শেষ কথা
শুধু অফিসার নয়, শিক্ষকরাও দোষী। নিজের সুবিধার জন্য কেউ ভুয়া মেডিকেল, কেউ ঘুষ দিয়ে ট্রেনিং চিঠি নিচ্ছেন। আবার সম্মানি না থাকলে কেউ ট্রেনিং করতে যান না।
অথচ অন্যান্য দেশে শিক্ষক নিজে খরচ করে নিজের উন্নয়ন করেন। আমরা শুধু ভাতা তুলতে ট্রেনিংয়ের লাইন দেই। এই দুর্নীতি বন্ধ না হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যত অন্ধকার।
শিক্ষক, কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় — সবাইকে একসাথে এগোতে হবে। না হলে এই লুটপাট যুগের পর যুগ চলতেই থাকবে।
এই প্রশিক্ষণ বাণিজ্য বন্ধ না হলে, হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়ে যাবে।
👉 অফিসার, শিক্ষক, ট্রেনার সবাই নিজেদের জায়গা থেকে সৎ হলে তবেই এই ব্যাধি থেকে মুক্তি সম্ভব।
👉 নইলে শিক্ষার নামে এই হরিলুট চলতেই থাকবে।
👉 আর জাতি পাবে মেরুদণ্ডহীন এক ভবিষ্যৎ।
সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে না বদলালে এই দুর্নীতি কোনোদিন যাবে না। এই লুটপাট বন্ধের জন্য এখনই সোচ্চার না হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই শেষ হয়ে যাবে।
জনগণের টাকার এই হরিলুট কবে বন্ধ হবে? সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে।
✨ আপনি কী ভাবছেন?
এই দুর্নীতি আর অপচয়ের বিরুদ্ধে আপনার মতামত জানান। শেয়ার করুন, আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক। কথা বলতে হবে, নইলে এই রোগ কখনো সারবেনা।
Leave A Comment