📖 বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষক ও তাদের ঈদ উদযাপন : এক আনন্দ-বেদনার গল্প
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি হলেন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণ। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা, সরকারি বিভিন্ন কাজ, সামাজিক দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি নিজের সংসার সামলাতে গিয়ে বছরের প্রতিটি দিন তাঁরা ক্লান্ত-শ্রান্ত।
কিন্তু যখন ঈদের মতো উৎসব আসে, তখন তাঁরা সামান্য কিছু পাওয়াকে বড় করে দেখতে শিখে নেন। আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অজস্র অভাব আর না বলা কান্না।
এই লেখায় আমরা জানবো, বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকদের ঈদের গল্প — যেখানে আনন্দের পাশে লুকিয়ে থাকে বাস্তবতার ভার।
📌 ঈদের প্রস্তুতিতে শিক্ষক পরিবার
ঈদ যতই আনন্দের হোক, অনেক মাধ্যমিক শিক্ষকের ঘরে সেই আনন্দ প্রবেশ করতে পারে না। কারণ, দেশের অধিকাংশ শিক্ষক অর্থনৈতিকভাবে সীমিত আয় নিয়ে জীবনযাপন করেন।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদিও ঈদে মূল বেতনের ৫০% বোনাস পান, তবে বর্তমান বাজারদর ও খরচের তুলনায় সেটি বেশ অপ্রতুল।
আর বেসরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষক ঈদ বোনাস তো দূরের কথা, ঠিকমতো মাসিক বেতনই পান না।
🎈 শিক্ষকের কষ্টের কথাঃ
✅ নতুন জামাকাপড় কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।
✅ সংসারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য কোরবানি বা ঈদের বাজার করতে গিয়ে ঘর ঋণে ডুবে যায়।
✅ সন্তানের মুখে হাসি দেখানোর তাগিদে নিজের চাহিদা চেপে রাখেন।
📌 ঈদের দিন : আনন্দের ভেতরে অভাব
ঈদের দিন অনেক শিক্ষক পরিবারের জন্য অপূর্ব এক মিলনের দিন। সকালের নামাজ, কোরবানি, খাওয়া-দাওয়া — সব কিছুই সীমিত সাধ্যের মধ্যে।
গ্রামে যাঁরা থাকেন, হয়তো কিছুটা সামাজিক সহযোগিতা পান। কিন্তু শহরে যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাদের ঈদটা অনেকটাই নিঃসঙ্গতায় কেটে যায়।
অনেকে পকেটে পাঁচশ’ টাকা নিয়েও সন্তানকে নিয়ে নামাজে যান, ফিরেও ঈদের দিন শুধু ডাল-ভাত আর এক টুকরো মাংসে ঈদ সারেন।
🎈 এমন হাজারো শিক্ষকের মুখে শোনা যায়ঃ
“ঈদটা শুধু ছেলেমেয়ের হাসির জন্য করি। নিজের নতুন জামার শখ ছিল একসময়, এখন শুধু বোনাসের টাকাটা দিয়েই সংসারের দেনা শোধ দিই।”
📌 ঈদ উৎসবে যে সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের অধিকাংশ মাধ্যমিক শিক্ষক ঈদের আগে যে কঠিন অবস্থার মধ্যে থাকেনঃ
✅ অর্থনৈতিক সংকট :
বর্তমানে বাজারে সব কিছুর দাম হু হু করে বাড়লেও শিক্ষকের বেতন বাড়েনি। কোরবানির গরু কেনা তো দূরের কথা, অনেক শিক্ষক ঈদে ছেলেমেয়ের জামা কিনতেই হিমশিম খান।
✅ ঈদ বোনাসের অনিশ্চয়তা :
বেসরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষক আজও ঈদ বোনাস পান না। অনেকে ঈদের দিনও বেতনের টাকা না পেয়ে পরিবার-পরিজনের কাছে লজ্জিত হয়ে থাকেন।
✅ পরিবার থেকে দূরে থাকা :
পোস্টিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষক স্ত্রী-সন্তান রেখে দূর-দূরান্তের স্কুলে চাকরি করেন। ঈদের সময় ভাড়া ও সময়ের অভাবে বাড়ি যেতে পারেন না। সেই ঈদ কাটে নিঃসঙ্গতায়।
✅ নিজের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যাওয়া :
অনেক শিক্ষকই ঈদের দিনে নিজের জন্য নতুন জামা তো দূরে থাক, পুরোনো পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজে যান। তবু সন্তানের হাসিটাকে বড় করে দেখেন।
📌 ঈদের দিনে শিক্ষক সমাজের অবদান
তবে অভাব-অনটন, সীমাবদ্ধতা পেরিয়েও শিক্ষকরা নিজেদের মানবিক দায়িত্ব ভুলে যান না।
✅ অনেকে ছাত্রছাত্রীদের ঈদের আগে নতুন জামা কিনে দেন।
✅ কেউ নিজের সীমিত আয় থেকে কোরবানির মাংস এতিমখানায় দেন।
✅ কেউ আবার দূরে থাকা প্রাক্তন ছাত্রদের ফোন করে ঈদের শুভেচ্ছা দেন।
✅ কোনো কোনো শিক্ষক ঈদের দিনেও কারো সন্তান অসুস্থ শুনলে হাসপাতালে ছুটে যান।
📌 শিক্ষক জীবনের আড়ালে আবেগ
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকদের জীবনে ঈদ মানে শুধু উৎসব নয় — এটি নাম না জানা ত্যাগ, না বলা কষ্ট আর লুকানো অভাবের দিন।
ঈদের দিনে কোনো ছাত্র-ছাত্রী ফোন করে “স্যার ঈদ মোবারক” বললে সেটা তাঁর জন্য বড় পাওয়া।
✅ “ঈদে নতুন কাপড় না হোক, সন্তানের মুখে হাসি থাকুক — সেটাই চাই।” — এমন কথা শোনা যায় অনেক শিক্ষকের মুখে।
✅ অনেকে কোরবানি দিতে না পেরে ঈদের দিনে ছেলেমেয়েকে নিয়ে শুধু ঈদের নামাজ পড়েই দিন কাটান।
📌 শেষকথা
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষক সমাজ এমন এক শ্রেণি, যারা কেবল শ্রেণিকক্ষেই নয় — সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের অবদান রেখে যান।
ঈদের দিনে পরিবার-পরিজন, ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের হাসির জন্য নিজের চাওয়া-পাওয়াকে বিসর্জন দেন।
তাদের কষ্টের গল্প, সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নেওয়ার গল্প আমাদের জানার প্রয়োজন আছে।
আমরা চাইবো, এই সমাজের এই মহান শ্রেণির মানুষগুলোর আর্থিক, সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়ুক। তাঁদের জন্য হোক নিরাপদ-নির্ভার ঈদের ব্যবস্থা।
শিক্ষক বাঁচলে, সমাজ বাঁচবে। শিক্ষক হাসলে, জাতি হাসবে।
Leave A Comment